ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম। মানুষের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সব নির্দেশনা এখানে বিদ্যমান। এমন কোনো সমস্যা নেই, যার কল্যাণমূলক সমাধান ইসলাম দেয়নি। তেমনি সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। মোটাদাগে বলা যায়, সামাজিক নিরাপত্তার যে বিষয়গুলো সব থেকে বেশি ভূলুণ্ঠিত; সেগুলো হলো- অন্যের সম্পদ অবৈধভাবে জবরদখল করা, নারীর অনিরাপত্তা, মানুষের প্রাণে সংশয়, সম্পদ চুরি ও নৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদি।
ইসলাম সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব বিষয়ের সুন্দর সমাধান দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে অন্যের সম্পদ অবৈধভাবে দখলের বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের ধন-সম্পদ গ্রাস করো না; কেবল পরস্পর সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করো তা বৈধ।’ -সুরা আন নিসা : ২৯
সম্পদ যেন কোনোভাবেই অবৈধ পন্থায় উপার্জিত না হয় এবং তা যেন শোষণের হাতিয়ার না হয়, সেদিকে লক্ষ্য করে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা ব্যবসাকে করেছেন হালাল, আর সুদকে করেছেন হারাম।’ -সুরা আল বাকারা : ২৭৫
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের পূর্ববর্তী সময়কে আইয়্যামে জাহেলিয়া তথা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলা হয়। ওই সময়ের সামাজিক অনাচারের বিষয়গুলো তুলে ধরে ইতিহাস ইসলামপূর্ব আরবের মানুষদের বর্বর বলে আখ্যা দিয়েছে। বিশেষ করে নারী নির্যাতন, নারীকে পণ্য বিবেচনা করে ভোগ এবং মেয়েশিশুকে জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যার ঘটনার কথা বর্বরতার প্রকাশের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
বর্তমান সময়ের সামাজিক অনাচারের ফিরিস্তি তুলে ধরলে আইয়্যামে জাহেলিয়ার সময়কার সামাজিক অনাচারের সঙ্গে অনেক খুঁজে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন দেখে এ কথা বলা বেশি হবে না। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা উল্লেখ করলে এমনটাই দেখা যাবে। এটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আমরা জানি, জীবনের নিরাপত্তা বিধান এবং জীবিকা নির্বাহের তাগিদে প্রাচীন যুগ থেকে সমাজব্যবস্থা চালু হলেও কালক্রমে সমাজের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই মানুষ এখন একটি সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র চায়। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষ একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ প্রত্যাশী। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সমাজ চাইলেই তো আর হবে না, এ জন্য সমাজে বসবাসরত সবাইকে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। এটাই ইসলামে বিধান ও শরিয়তের হুকুম।
সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় পারস্পরিক মানবিক দায়িত্ব পালন, পরস্পরে সম্মান প্রদান গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে না, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ একটি সুন্দর সমাজ গঠনে এ গুণটি সবার মেনে চলা উচিত।
মূলতঃ পাপের কারণে মানুষের অন্তরাত্মা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়, তার আত্মা ঢেকে যায় অন্ধকারাচ্ছন্নতার চাদরে। সে তখন নানা বিপদ-আপদে আক্রান্ত হয়ে ভালো কাজের শক্তি-সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। এ কারণে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে বারবার এ সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, পাপ থেকে দূরে অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন এবং পাপের কারণে অতীত জাতিগুলোর ওপর যেসব আজাব-গজব নেমে এসেছিল, তার বিবরণ তুলে ধরে সবিস্তারে সাবধান হওয়ার পাশাপাশি এগুলো থেকে শিক্ষাগ্রহণের কথা বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখো, তাদের কিছু পাপের কারণে আল্লাহ তাদের শাস্তি দিতে চান।’ -সুরা আল মায়িদা : ৪৯
ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজের ওপরও পাপ এবং পাপাচারের নেতিবাচক নানা প্রভাব পড়ে। যা ক্রমেই সমাজকে পাপের খেলায় মত্ত করে তোলে, ধ্বংসের বীজ ছড়িয়ে দেয়। সমাজে পাপাচার ও তার ক্ষতিকর প্রভাব বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পাপাচারের কারণে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির বিস্তার ঘটে, দূষিত হয় পরিবেশ। দেখা দেয় নিরাপত্তার অভাব, বিঘ্ন ঘটে শান্তি-শৃঙ্খলার, ভয়-ভীতি ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহভাবে। কখনও অনাবৃষ্টি, কখনও অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প, ঝড়-তুফানসহ দেখা দেয় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানববিধ্বংসী যুদ্ধ, আগ্রাসন ইত্যাদি অস্বাভাবিকতা মানুষের পাপাচারেরই ফসল।
তাই ইসলাম সব পাপ ও অন্যায়-অনাচার থেকে বাঁচার জন্য সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা দিয়েছে। নেকি হলো টনিকের মতো। আর গোনাহের উদাহরণ হলো- বিষের মতো। মানুষের সাধারণ অভ্যাস হলো, তারা অনেক নেক কাজ করে, অনেক অনেক নফল নামাজ পড়ে, প্রচুর জিকির-আজকার করে। কিন্তু গোনাহ থেকে বাঁচার ব্যাপারে সতর্ক হয় না, গুরুত্বারোপ করে না। অথচ গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার গুরুত্ব বেশি।
তাই ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, ফরজ-ওয়াজিব আদায়কে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়; সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।