জিহ্বার নিয়ন্ত্রণে পাপ কম হয়

বিশেষ নিবন্ধ, ইসলাম

মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-09-01 08:03:39

মানুষ যখন কোনো কথা বলবে, তখন তাকে চিন্তা করতে হবে- এই কথায় কোনো উপকার ও কল্যাণ রয়েছে কিনা। কথা বলার আগে ভাবা, তারপর বলা। কারণ না ভেবে কথা বলার কারণে অনেক সময় লজ্জিত হতে হয়, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয়।

জবান দিয়ে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা না ছড়ানো। বিশেষভাবে ফেসবুকে, লোকমুখে শুনে কিংবা পত্র-পত্রিকায় কিছু দেখেই অনেকে যাছাই-বাছাই না করা তা অন্যকে বলা শুরু করে দেন। এটাও জবানের অপব্যবহার। এটা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‘মানুষ যা বলে- তা আমল লেখক সম্মানিত ফেরেশতাগণ রেকর্ড করেন।’ -সুরা ইনফিতার : ১০-১১

হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘ফেরেশতাগণ মানুষের প্রতিটি বাক্য রেকর্ড করেন।’ আর হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কেবল সেই সব বাক্য লিখিত হয়; যেগুলো সওয়াব কিংবা শাস্তিযোগ্য।’

বলা হয়, তরবারির আঘাতে কারও শরীরে ক্ষত হলে তা শুকিয়ে যায়। কিন্তু জিহ্বার আঘাতের ক্ষত সহজে শুকায় না। কারণ তরবারির আঘাত লাগে দেহে, আর জিহ্বার আঘাত লাগে কলিজায়। তাই এমনভাবে কোনো কথা বলা উচিত নয়, যা কারও হৃদয়ে আঘাত করে। কবি বলেন, বর্শার জখম শুকিয়ে যায়, কিন্তু জবানের জখম শুকায় না। অতএব আমাদেরকে ভাবা দরকার, আমি আমার মুখের ভাষা দ্বারা কাউকে কষ্ট দিয়েছি কি-না। যদি তা করে থাকি তার কাছে ক্ষমা চাওয়া প্রয়োজন। আর অনুমাননির্ভর কোনো কথা না বলে তথ্য যাচাই-বাছাই করে কথা বলা কিংবা তথ্য দেওয়া দরকার। এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে অনুমান করে কথা বলো না। কেননা কর্ণ চক্ষু হৃদয় ওদের প্রত্যেকের বিষয় কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ -সুরা বনি ইসরাঈল : ৩৬

জবানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল ধরনের গোনাহ থেকে সবাইকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে। কারও নাম ব্যঙ্গ করা, বিদ্রুপ করা, অশ্লীল কথা বলা, গালি দেওয়া, পরনিন্দা করা, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, চোগলখুরি করা, বিনাপ্রয়োজনে গোপনীয়তা ফাঁস করা, মুনাফেকি করা, হারাম বা নাজায়েজ জিনিস নিয়ে আলোচনা করে আনন্দ পাওয়া, গিবত করা, খারাপ উপনামে ডাকা, অভিশাপ দেওয়া, অযথা চিৎকার করে চেঁচামেচি করা, বেহুদা কথা বলা, মিথ্যা কথা বলা, অশ্লীল গান গাওয়া, কারও মুখোমখি প্রশংসা করা, আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কথা না বলা, কেউ মারা গেলে উচ্চ স্বরে বিলাপ করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।

জিহ্বা যেসব কারণে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয় না তা চিহ্নিত করতে হবে। যেমন আমরা অধিক রাগের কারণে অনেক সময় মেজাজের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে জয় লাভ করাতে বীরত্ব নেই বরং ক্রোধ ও রাগের মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করতে পারাই প্রকৃত বীরত্বের লক্ষণ।’

জনৈক সাহাবা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে অসিয়ত করুন। আল্লাহর রাসুল বলেন, ‘লা-তাগযাব, তুমি রাগ করো না। এ কথা তিনি বারবার উল্লেখ করেন। রাগ নিয়ন্ত্রণ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য।’ -সুরা আলে ইমরান : ১৩৪

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাগ নিয়ন্ত্রণ করে, অথচ সে তা বহিঃপ্রকাশ করতে সক্ষম। তাকে আল্লাহতায়ালা যেকোনো হুর নির্বাচনের ক্ষমতা দেবেন।’ কারও অপরাধ ক্ষমা করা মহত্ত্বের লক্ষণ। কারও দুঃখ-কষ্ট কিংবা অন্যায় ক্ষমা করে দিলে তার সঙ্গে খারাপ কথা বলার প্রশ্নই উঠে না। একজন মুমিন আরেকজন মুমিনকে হৃদয় থেকে ক্ষমা করে দেয়।

হজরত উকবা ইবন আমের (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে উকবা আমি কি তোমাকে দুনিয়া ও আখেরাতবাসীর সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য বলব। (আর তা হলো) যে তোমার সঙ্গে সম্পর্কছেদ করবে তুমি সম্পর্ক গড়বে, যে তোমাকে বঞ্চিত করেছে তুমি তাকে দান করবে; আর যে তোমার প্রতি জুলুম করেছে, তুমি তাকে ক্ষমা করবে। আল্লাহ অন্যকে তার ভুলের জন্য ক্ষমা করতে বলেছেন।’

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জনৈক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার কিছু আত্মীয়-স্বজন আছে আমি তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করি, কিন্তু তারা আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি, কিন্তু তারা আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। আমি তাদের বেলায় সহ্য করি কিন্তু তারা আমার সঙ্গে মন্দ আচরণ করে। তখন তিনি বললেন, যদি তুমি তোমার কথায় সত্যবাদী হয়ে থাক- তাহলে তুমি যেন তাদের মুখে গরম ছাই প্রবেশ করাচ্ছ। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা তোমার সাহায্যে রত থাকবে যতক্ষণ তুমি সে অবস্থার ওপর থাকবে। -সহিহ মুসলিম

প্রতিনিয়ত আত্মপর্যালোচনা ও আত্মপর্যবেক্ষণ করা। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন।’ -সুরা হাদিদ : ৪

আল্লাহতায়ালা চোখের ঘাতকতা ও মনের গোপন কথা জানেন। -সুরা গাফের : ১৯

আগেই বলা হয়েছে, আমাদের সব কথা রেকর্ড হচ্ছে। অতএব আমাদেরকে প্রতিনিয়ত আত্মপর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আমরা মুখের ভাষা ও জিহ্বা দিয়ে কাউকে কষ্ট দিয়েছি কি-না? কারও প্রতি কটূ কথা বলেছি কি-না? শরিয়তের সীমালংঘন হয়েছে কি-না?

ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, জিহ্বা বা ভাষা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজস্ব কোনো পন্থা অবলম্বন করা। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) একদিন স্বীয় জিহ্বা ধরে বসেছিলেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এমনটি করছেন কেন? তিনি জবাব দেন, এই জবান আমাকে ধ্বংসের দিকে নিপতিত করছে। এ জন্য আমি এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়াস চালাচ্ছি।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! যিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। জিহ্বা ব্যতীত ভূপৃষ্ঠে আর কোনো বস্তু নাই, যাকে দীর্ঘসময় কারারুদ্ধ করে রাখা প্রয়োজন।’

ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে সংশোধনের অঙ্গ হলো- তার জিহ্বা।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর