কেন বলবেন আলহামদুলিল্লাহ?

বিশেষ নিবন্ধ, ইসলাম

নোমান আলী খান | 2023-09-01 23:44:04

মুসলিম সমাজের একদল মানুষ রয়েছেন, যারা তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময়ে সবক্ষেত্রে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’ নিঃসন্দেহে এটি আল্লাহর রহমত যে, আমরা এমন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত যারা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলার সৌভাগ্য পেয়েছি। আমাকে যদি বলা হয় ‘আলহামদুলিল্লাহ’র অর্থ নিয়ে আলোচনা করতে, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতে পারব ইনশাআল্লাহ; তবে প্রকৃতপক্ষে এর মূল অর্থ দুটি। প্রথমটি হলো, আল্লাহর প্রতি আপনি কৃতজ্ঞ, কৃতজ্ঞতা (শুধু) আল্লাহর জন্য। আর দ্বিতীয় অংশ হলো, প্রশংসা, প্রশংসা আল্লাহর জন্য। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়, কৃতজ্ঞতা এবং প্রশংসা দুটি আলাদা বিষয়।

একদিকে প্রশংসা করা অর্থে বোঝানো আর অন্যদিকে কৃতজ্ঞতা অর্থে, দুটি ভিন্ন দিক। এখন চলুন আমরা এই দুটি বিষয়ের পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করি।

মনে করুন, আপনি একটি সুন্দর বাড়ি দেখে প্রশংসা করলেন, এক্ষেত্রে কিন্তু আপনি বাড়িটিকে ধন্যবাদ দিতে যাবেন না। আবার আপনি হয়তো একজন খেলোয়াড় দেখলেন, যিনি ফুটবল খেলেন এবং তিনি একটি অসাধারণ গোল করলেন। আপনি ওই খেলোয়াড়ের প্রশংসা করবেন; কিন্তু আপনি ওই খেলোয়াড়কে ধন্যবাদ দেবেন না অথবা আপনি তার প্রতি কৃতজ্ঞ হবেন না। আবার মাঝে মাঝে উল্টোটাও ঘটে। কিছু মানুষের প্রতি আপনি কৃতজ্ঞ থাকেন যদিও আপনি কখনও তাদের প্রশংসা করবেন না।

এমনটাও ঘটতে পারে, যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে- আল্লাহতায়ালা একজন মুসলিমকে সব অবস্থাতেই তার বাবা-মার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে আদেশ করছেন, এমনকি বাবা-মা অমুসলিম হলেও! যদি তারা আপনাকে শিরক করার জন্য জোর করেন, তারা চান আপনি ঈমান ত্যাগ করেন, তারপরও আপনাকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। আপনি তাদের শিরকের প্রশংসা করবেন না; কিন্তু তারপরও আপনি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন।

সুতরাং, জীবনের মোড়ে মোড়ে আপনি প্রশংসা পেতে পারেন কৃতজ্ঞতা ছাড়া, আবার কখনও কখনও কৃতজ্ঞতা পাবেন প্রশংসা ছাড়া। বিষয়টি আরও সহজ করে তুলে ধরার জন্য আমি আপনাদের কাছে আরও একটি উদাহরণ দেব। যেখান থেকে একজন ব্যক্তি যার মধ্যে কৃতজ্ঞতা আছে; কিন্তু প্রশংসা নেই, বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।

আপনারা ফেরাউনের কথা জানেন। ফেরাউন পছন্দ করুক কিংবা না করুক সে হজরত মুসা (আ.) কে তার প্রাসাদে বড় করেছে। পরে দীর্ঘ সময়ের পর হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের কাছে ফিরে আসেন। এরপর ফেরাউন হজরত মুসা (আ.) কে মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুমি কি এখানে অনেক বছর থাকনি? তুমি কি এখানে অনেক বছর পার করোনি? আমি কি তোমাকে শৈশবকাল থেকে বড় করিনি? ফেরাউন কথাগুলোর মাধ্যমে তার দয়ার কথা হজরত মুসা (আ.) কে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবে কেউ যখন আপনার উপকার করে, আপনি তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন। তাই হজরত মুসা (আ.) স্বয়ং এই উপকারের কথা স্বীকার করেন এবং ফেরাউনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। হজরত মুসা (আ.) বলেন, ‘হ্যাঁ, তুমি আমার প্রতি দয়া করেছিলে।’

আপনি যখন কারও প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই আপনি তাকে ধন্যবাদ দেবেন। একই কাজ হজরত মুসা (আ.)ও করেন; তিনি ফেরাউনকে ধন্যবাদ দেন। কিন্তু হজরত মুসা (আ.) তার জীবনদ্দশায় কখনোই তার প্রশংসা করেননি। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, আপনি কাউকে ধন্যবাদ দিতে পারেন প্রশংসা ছাড়া আর কাউকে প্রশংসা করতে পারেন কৃতজ্ঞতা ছাড়া।

যখন আমরা আলহামদুলিল্লাহ বলি, এর অর্থ আমরা বলছি যে, ‘আমরা আল্লাহর প্রশংসা করছি তিনি যা কিছু করেন তার জন্য।’ আল্লাহ পাক যা করেন তার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। তার প্রশংসার পর আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি যে, তিনি যা করেছেন সেটার জন্য।

আলহামদুলিল্লাহ, আমরা আল্লাহর প্রশংসা করছি তিনি যা কিছু করেন তার জন্য 

 

আজ উপস্থিত অনেকেই বাইরে বসে আছেন। আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যার জন্য হয়তো এয়ারকন্ডিশন যথেষ্ট নয় এবং ভাবছেন- উফ যা গরম। কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে আপনার মনে প্রথমে আসা উচিত ছিল-আলহামদুলিল্লাহ আজ বেশ গরম। এর মানে কি আপনি জানেন? এর অর্থ আল্লাহকে ধন্যবাদ গরমের জন্য এবং আমি আল্লাহর প্রশংসা করি গরমের জন্য। এটি ভিন্ন ধারার চিন্তা, যা আর দশজনের মতো নয়।

কিছু মানুষ আছে যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে। সব ধর্মের মানুষের সঙ্গেই আমার দেখা হয়। কিছু মানুষ আছে যারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে; কিন্তু তাদের যেটা নেই, সেটা হলো ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

আবার কিছু মুসলিম আছে যারা আলহামদুলিল্লাহ অর্থ বোঝে না। তাই মাঝে মধ্যে তারা বলে, ‘আমি বেতন বেশি পাই না, তবে যাই হোক, আলহামদুলিল্লাহ!’ বাস্তবিক অর্থে আপনি তখন আলহামদুলিল্লাহ বলছেন না। আপনি অভিযোগ করছেন আলহামদুলিল্লাহ বলার মধ্য দিয়ে। আবার হয়তো আপনি এবং আপনার পরিবার সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়- পরিবারের সবাই কেমন আছে? আর জবাবে যদি বলেন, এই আছে আরকি, আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে কিন্তু বিষয়টি ভিন্ন। কেননা, এই আলহামদুলিল্লাহ বলা কিন্তু সত্যিকারের আলহামদুলিল্লাহ নয়। আলহামদুলিল্লাহ হচ্ছে আপনার অন্তরের অন্তস্থল থেকে আপনি কৃতজ্ঞ। যা কিছু ভুল ঘটে যাচ্ছে, তার মাঝেও আপনি ভালো কিছু খুঁজে পাবেন।

আপনি যদি গরম অনুভব করেন, অন্তত আপনি অসুস্থ তো বোধ করছেন না। আপনার আরও কিছু খারাপ হতে পারত। আপনি জানেন, যদি আপনার গাড়ির ট্রান্সমিশন সমস্যা থাকে, অন্তত গাড়ির ইঞ্জিনে তো কোনো সমস্যা নেই। আপনার অনেক কিছুই ঠিকমতো চলছে।

আমরা সে দলের মানুষ, যারা আলহামদুলিল্লাহ বলি। কিন্তু তার অর্থ জানেন কি? এর অর্থ-আমরা সবসময় কৃতজ্ঞ, আমরা সবসময় ইতিবাচক। আমরা যদি আলহামদুলিল্লাহ শব্দটা বুঝতাম, তাহলে আমরা কখনও হতাশ হতাম না। একজন মুসলিম কখনও হতাশ হতে পারে না।

বর্তমান সময়ে আপনি উম্মাহর মধ্যে দেখতে পারবেন, কিছু মানুষ মুসলিমদের অবস্থার জন্য অভিযোগ করছে। যেমন ধরুন, আমরা মুসলিমদের অজ্ঞতার জন্য অভিযোগ করি অথবা মুসলিমদের মাঝে দুর্নীতির ব্যাপারে অভিযোগ করি। আমরা মূলত করতে পারি অভিযোগ, অভিযোগ আর শুধু অভিযোগ। আমি আপনাদের বলছি, তিনি আল্লাহ, যিনি আমাদের অবস্থার পরিবর্তন করেন। আমাদের যা করতে হবে তা হলো, আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে। আমাদের ইতিবাচক থাকতে হবে, ইতিবাচক দলের মানুষ হতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : কারিশমা আনান

এ সম্পর্কিত আরও খবর