ওয়াজ যেমন হওয়া চাই

বিশেষ নিবন্ধ, ইসলাম

আল্লামা মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-09-01 20:07:39

বয়ান ও বক্তৃতার দু’টি ধারা। একটির উদ্দেশ্য আল্লাহতায়ালাকে রাজি-খুশি করা, নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা এবং মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা। অপরটির উদ্দেশ্য, মানুষের বাহ্ বাহ্ কুড়ানো, অর্থ উপার্জন করা এবং মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করা ইত্যাদি।

প্রথম ধারাটি হলো নবী আলাইহিমুস সালামের ধারা, নবীদের তরিকা।

দ্বিতীয় ধারা তথা বাহ্ বাহ্ কুড়ানোর উদেশ্যে বয়ান, যা নবীদের পথ-পদ্ধতি ও তরিকা নয়। এটি সাময়িকভাবে মানুষ পছন্দ করে, কিন্তু এর ফলাফল শূন্য। এ ধারার বাহ্যিক প্রতিক্রিয়ায় মনে হয়, মানুষ বয়ান খুব বুঝেছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলতে পারে না।

এক. ওয়াজ শোনে মানুষজন কি শিখছে, তাদের কী উপকার হচ্ছে- বক্তাকে অবশ্যই সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দু’তিন ঘন্টা বয়ান-বক্তৃতা করলাম, দুই লাইন শেখার মতো নেই। এই যে হাজার হাজার মানুষের সময় নষ্ট হলো, তার জবাবদিহি কি আল্লাহর দরবারে করতে হবে না? আল্লাহ যদি জিজ্ঞাস করেন, এই যে মানুষগুলো তোমার কথা শুনতে গিয়েছে, তোমার বক্তব্য দ্বারা মানুষ কী শিখেছে? আমাকে কী পরিমাণ পেয়েছে। নাকি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য কথা বলেছ? তখন কি জবাব দেবে?

সুতরাং আল্লাহকে রাজি-খুশি করার উদ্দেশ্যে নরম ও কোমল ভাষায় কথা বলতে হবে। দেড় দুই ঘন্টা বয়ান করলাম, কিন্তু সেখানে শেখার কিছু নেই; এমন যেন না হয়। আমি চিৎকার করলাম, ওরাও চিৎকার করলো, এটা নবীদের তরিকা নয়। আমি তো ভাবছি, আমি খুব বলেছি, আসলে কিছুই বলা হলো না। এর দ্বারা না বক্তার উপকার হবে, না শ্রোতার। এ জন্য কথা বলতে হবে নরম ও কোমল ভাষায়। কোমল কথার দ্বারা যে পরিমাণ উপকার হয়, গরম কথার দ্বারা সে উপকার হয় না। বরং হিতে বিপরীত হয়।

খলিফা মানসুর যে মসজিদে জুমা পড়তেন, ওই মসজিদে একজন ওয়ায়েজ গেলেন ওয়াজ করতে। বক্তা বয়ান করতে দাঁড়িয়ে যখন খলিফা মানসুরকে দেখলো, তখন তার জজবা বেড়ে গেল। খলিফা মানসুরকে সামনে পেয়ে তিনি খুব গরম বক্তব্য দিলেন। নামাজ শেষে খলিফা তাকে ডাকলেন। বিনীতভাবে জানতে চাইলেন, হুজুর! আমি ভালো, না ফেরাউন ভালো? ওয়ায়েজ বললেন, আপনি কী বলেন, ফেরাউন তো আল্লাহর দুশমন, আর আপনি হলেন খলিফাতুল মুসলিমিন, আমিরুল মুমিনিন। আপনার সঙ্গে কি ওর তুলনা হয়। খলিফা বলেলেন, এবার বলুন, আপনি উত্তম, না নবী মুসা উত্তম? ওয়ায়েজ বলল, কি বলেন, আমি হলাম গোনাহগার, আর মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর নবী। এর তুলনা হয় কীভাবে? এরপর খলিফা বললেন, আমার থেকে নিকৃষ্ট ফেরাউনের কাছে আপনার থেকে উত্তম মুসা নবীকে পাঠানোর সময় আল্লাহতায়ালা কি বলেননি, আপনারা তাকে কোমল ভাষায় কথা বলবেন। ফেরাউনকে নরম কথা বলার নির্দেশ দেননি? আপনি যে আমাকে এমন গরম ভাষায় কথা বললেন, তা কি ঠিক হয়েছে? বক্তা মাথা নিচু করে ফেলল।

হাফেজ সিরাজি বলেছেন, ‘স্টেজে ওঠে এত গরম বয়ান, মনে হয় তার চেয়ে বুজুর্গ আর কেউ নাই। আর যখন নির্জনে যায়, তখন নামাজ-কালামের খবর নাই। আল্লাহ মাফ করুন।’

আল্লাহকে রাজি-খুশি করার উদ্দেশ্যে নরম ও কোমল ভাষায় কথা বলতে হবে



দুই. আমাদের সব কাজের আগে দেখতে হবে, কাজটা আল্লাহর জন্য কি না? এজন্য কখনও বক্তব্যের সুযোগ এলে মনে মনে এ দোয়া করা, ‘ইয়া আল্লাহ! একনিষ্ঠভাবে সুন্নত অনুযায়ী আপনার সন্তুষ্টি মোতাবেক বলিষ্ঠ কণ্ঠে কিছু কথা বলার তওফিক দান করুন, যাতে আপনার বান্দাদের উপকার হয় এবং তৃপ্তি লাভ হয়।’ ইনশাআল্লাহ, দেখবেন আপনার বয়ান মানুষের মনে প্রভাবি বিস্তার করবে, বয়ান ফলপ্রসূ হবে।

তিন. ওয়াজ করতে গিয়ে কখনও এ কামনা না করা, আমার ওয়াজ সুন্দর হোক। আমার ওয়াজ উচ্চমানের হোক। এটা মনে আনা যাবে না। বরং এ কথা কামনা করতে হবে, আমার কথাগুলো যেন মানুষ বুঝতে পারে। যেভাবে বললে মানুষ বুঝবে ওইভাবে বলতে হবে।

চার. অনেকে মনে করেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আলোচ্য বিষয় শেষ করতে হবে। ব্যস, উঠেই কথা শুরু। দাঁড়ি নাই, কমা নাই। এতে মানুষ বয়ান বুঝে উঠতে পারে না। কথা হতে হবে, ধীরস্থিরভাবে। সময়ের ভেতর যতটুকু সম্ভব, ততটুকু বলবে। বাকিটা রয়ে গেলে সমস্যা নেই, কথা শেষ পর্যন্ত বলতে হবে, এটা জরুরি নয়। এতে করে মানুষের আগ্রহ কমে যায়। বরং আগ্রহ থাকতেই কথা শেষ করতে হবে। তা হলে কথা মানুষের হৃদয়ে বক্তব্যের বিষয় বসে যাবে। নতুবা কথার প্রতি তিক্ততা আসবে। ফলে মানুষ আর কথা শুনতে চাইবে না। ইবাদত-বন্দেগিও এই নিয়মেই করতে হয়। যতক্ষণ অন্তরে আগ্রহ থাকে, ততক্ষণ ইবাদত করা। আগ্রহ থাকতে থাকতে ইবাদত ছেড়ে দেওয়া। বিরক্তি এসে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিৎ নয়। তদ্রুপ চাহিদা থাকতেই বয়ান শেষ করা উচিত।

পাঁচ. সবচেয়ে বড় কথা হলো, বয়ানের ওপর প্রথমে নিজেকে আমল করতে হবে। যে ব্যক্তি ব্যক্তিগত জীবনে আমলদার, তার ওয়াজে যে ফায়দা ও প্রভাব সৃষ্টি হয়, তা অন্যদের ওয়াজে হয় না। এক মজলিসে একবার হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর আগে বয়ান করেছেন তারই ছেলে। পরে তিনি এসে মিম্বরে বসলেন। আর শুধু এতটুকু কথা বললেন, ‘রাতে একটু দুধ রাখলাম সকালে পান করার জন্য। সকালে উঠে দেখি বেড়ালে খেয়ে ফেলেছে। আমি আর পান করতে পারিনি।’ এ সামান্য কথায় মাহফিলে কান্নার রোল পড়ে গেলো। অথচ এর আগেরকার লম্বা কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দিল না।

ছয়. অন্যের ওয়াজ নকল ও অনুকরণ না করা। অন্যের ওয়াজ মুখস্ত করে শুনিয়ে দিলাম, এমন যেন না হয়। হ্যাঁ, অন্যের ওয়াজ থেকে বিষয় নির্বাচন করতে পারবেন, কিন্তু ব্যক্ত করতে হবে নিজের ভাষায়, নিজের ভঙ্গিতে। এজন্য নবী-রাসুল ও পূর্ববর্তী বুজুর্গদের জীবনী পড়া, তাদের লিখিত কিতাবাদি অধ্যয়ন করা।

অনুলিখন : মাওলানা সাইফুল্লাহ দেলাওয়ারী

এ সম্পর্কিত আরও খবর