ইমাম-খতিবগণ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও বিশেষ সম্মানের অধিকারী। তারা মসজিদে প্রতি জুমায় মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বয়ান দেন। তাদের বয়ানে ইসলামের মূলনীতি, নান্দনিক আদর্শ, কোরআন-হাদিসের বিধান ও ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য যেমন থাকে, তেমনি থাকে সমকালীন সময় সম্পর্কে ইসলামের দিক-নির্দেশনা।
জুমার দিন লাখ লাখ মুসল্লি গুরুত্ব সহকারে খুতবা ও খুতবাপূর্ব বয়ান শুনেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশে প্রায় ছোট-বড় তিন লাখ মসজিদ রয়েছে। এমতাবস্থায় পরিকল্পনা করে, গবেষণালব্ধ উপকারী বিষয়ে খুতবা কিংবা খুতবার আগের বয়ান করা হলে মানুষ আরও বেশি উপকৃত হবে।
সাধারণত বাংলাদেশে মসজিদগুলো এলাকাভিত্তিক কমিটির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারির নীতি-আদর্শের বাইরে মসজিদের ইমাম-খতিবরা চলতে পারেন না, বক্তব্যও রাখতে পারেন না। বলতে গেলে বিভিন্নভাবে ইমাম-খতিবদের একপ্রকার কণ্ঠরোধ করে রাখা হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু বলার জন্য ইচ্ছা থাকলেও পেটের দায়ে ইমাম-খতিবরা তা বলতে পারেন না।
ইমাম-খতিবরা কোরআন-হাদিসের ওপর বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হোন। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, দলীয় আদর্শ কিংবা একই পীরের অনুসারী এমনকি মাজার ও মাদরাসাভিত্তিক চিন্তাধারায় লালিত ব্যক্তিতে মসজিদের ইমাম-খতিব নিয়োগ দেওয়া হয়। কমিটির মন জয় করতে পারাকে ইমাম-খতিবের বড় যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
যে প্রয়োজনে জুমার খুতবা প্রদান এবং শোনা ওয়াজিব করা হয়েছে, এমন মনোভাবের করাণে তার কার্যকারিতা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সমাজ সংস্কারে যে ভূমিকা খুতবার ভাষণ থেকে আসার কথা ছিলো, তা এখন সমাজে মারাত্মকভাবে অনুপস্থিত। এর অন্যতম কারণ ইমাম-খতিবরা এলাকার কমিটি দ্বারা পরিচালিত, তাদের খেয়াল-খুশিমতো চলতে হয়। তারা বেতন-ভাতার জন্য কমিটির ওপর নির্ভরশীল। কমিটির নিয়ন্ত্রণে তাদের চলতে হয়। এমন বন্দিত্বের শিকল থেকে খতিব-ইমামদের মুক্ত করতে না পারলে, তাদের পক্ষে সমাজ সংস্কার করা সম্ভব নয়।
নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সমাজ সংস্কারে তার সাহাবাদের মসজিদভিত্তিক শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই শিক্ষা এখন আর মসজিদের মেহরাব থেকে আসছে না। ফলে সমাজে দেখা যাচ্ছে, নানা ধরনের অনাচার ও ইসলাম বিরোধী কাজ। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, অনেকাংশেই ইমাম-খতিবরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, ফলে মসজিদ কমিটির বাইরে বক্তব্য রাখতে পারেন না। মসজিদ পরিচালনা, ইমাম-খতিবদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্রের মনোযোগ কাম্য।
ইমাম-খতিবরা সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। তাদের বক্তব্য যেখান থেকে প্রচারিত হয়, সেই মেহরাব মুসলিম সমাজের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। এমতাবস্থায় ইমাম-খতিবদেরকে যদি আর্থিক এবং সরকারি ক্ষমতা দেওয়া হয়, তারা যেকোনো কর্মসূচি শতভাগ সফল করতে পারবে। কারণ মহল্লার ইমাম-খতিবদের সঙ্গে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা না থাকার কারণে তারা সেভাবে বক্তব্য ও উপদেশ দিতে পারেন না। অথচ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইমাম-খতিবদের ভূমিকা অনেক।
এ কথা বললে বেশি বলা হবে না, এখনও সমাজে কিছু সংখ্যক ভালো মানুষ থাকলে- তার মধ্যে ইমাম-খতিবরা সবথেকে ভালো ও নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ। তারা সমাজে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত। সমাজকে আলোকিত করতে প্রতি জুমায় তাদের বিষয়ভিত্তিক নানা ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়। অথচ তারা অবহেলার শিকার। এ অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ইমাম-খতিবরা যেমন সমাজ ও মানুষকে ভালোবেসে নিয়মিত আলো দিয়ে যাচ্ছেন, অনুরুপ তাদেরকেও সম্মানের সঙ্গে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার দেওয়া দরকার। তাদেরকে সমাজ উন্নয়নমূলক নানা কাজে ব্যবহার করলে দেশ এগিয়ে যাবে। ধর্মীয় হানাহানি বন্ধ, মানবতাবিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডের বিষয়ে জনমত গঠন, মাদকের কুফল, সন্ত্রাসের ভয়াবহতা, নারী নিগ্রহের অপকারিতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, সমাজের স্থিতিশীল উন্নয়ন ধরে রাখা এবং পরিবেশ শান্ত রাখার জন্য তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধী, মাদক নেশা, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ তাদের বক্তব্য ও ভূমিকা অন্যসব কর্মসূচীর চেয়ে ফলদায়ক। অতি সহজে তারা যেকোনো কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে উপকৃত করার ক্ষমতা রাখেন। যা অন্যকোনো বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য কঠিন ও ব্যয়বহুল।
ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ থেকে সমাজ উন্নয়নের শিক্ষা-দীক্ষা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইমাম-খতিবরা এখনও নিভু নিভু হলেও, ক্ষীণ কণ্ঠে ইসলামের শিক্ষা সমাজে প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখছেন। এমতাবস্থায় অবহেলা কিংবা নিয়ন্ত্রণের নামে তাদের কন্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হবে ভুল সিদ্ধান্ত। তাদের কথা, বক্তব্য সর্বদা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আলোর পক্ষে। কোরআন-হাদিসের আলোকে তাদের আলোচনা-সমালোচনায় রয়েছে সমাজের জন্য শিক্ষার অনেক কিছু। আবহমানকাল থেকে এ ধারা চলে আসছে। ইতিহাস সাক্ষী, মসজিদের ইমাম-খতিবরা নির্মোহভাবে সমাজকে আলো দিয়েই যাচ্ছেন। সুতরাং তাদের নিয়ন্ত্রণ নয়, তাদের পাশে রেখে তাদের যোগ্যতা, জ্ঞান, মেধা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা দরকার। আশা করি, সমাজ উন্নয়নে সম্পৃক্ত দায়িত্বশীলগণ বিষয়টি নিয়ে ভেবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।