সাহাবি হজরত আনাস রাযিয়াল্লাহু বলেন, আমি ১০ বছর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেবায় কাজ করেছি। আল্লাহর কসম! একবারের জন্য তিনি আমাকে ‘উফ’ পর্যন্ত বলেননি, কখনও কঠোর কন্ঠে বলেননি, তুমি কেন এটা করেছ? অথবা তুমি কেন ওটা করোনি? –সহিহ বোখারি
বর্ণিত এই হাদিসে রয়েছে উম্মতের জন্য শিক্ষণীয় অনেক বিষয়। দেখুন, হজরত আনাস (রা.) বলেছেন, আমি ১০ বছর ধরে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে চিনতাম, কিংবা বলেননি ১০ বছর তার বাসায় গিয়েছি, তিনি বলেছেন, আমি ১০ বছর তার সেবা করেছি, অর্থাৎ ১০ বছর প্রতিনিয়ত তার সঙ্গে ছিলাম। হজরত আনাস (রা.) কি এই ১০ বছরে কোনো কাজে কোনো ভুল করেননি? এটা হতে পারে না; অবশ্যই কিছু ভুল তিনি করেছিলেন। কোনো কোনো কাজ হয়তো ঠিকমতো করতে পারেননি। কিন্তু তার পরও হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) একবারের জন্যও ‘উফ’ বলেননি। বিরক্তি প্রকাশ করেননি। রাগ দেখানো তো দূরে থাক।
বস্তুত একজন মানুষ তার পরিবারের মানুষদের সঙ্গে, কাছের মানুষদের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করে- তার মাধ্যমে তার প্রকৃত রূপ প্রকাশ পায়। কারণ বাইরের মানুষের সঙ্গে সবাই ভদ্রভাবে কথা বলে। সারাক্ষণ যাদের সঙ্গে থাকা হয়, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা বেশি কঠিন।
বর্ণিত হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, সর্বক্ষণ সেবক হিসেবে কাজ করা হজরত আনাস (রা.)-এর সঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর ব্যবহার কেমন কোমল, ধৈর্য্যশীল ছিল। আমরা যদি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর এই একটিমাত্র গুণকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারি, নিজের করে নিতে পারি, তাহলে মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক চিরদিনের জন্য বদলে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমরা তা করতে পারি না। মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার তো পরের কথা, উল্টো বাসা-বাড়িতে যারা কাজ করে তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহার ও মারধরের ঘটনা দেখা যায়।
পারিবারিক জীবনে আমরা কম-বেশি সবাই গৃহকর্মীর ওপর নির্ভরশীল। দিন দিন বাড়ছে এই নির্ভরতা। আমাদের ছোট ছোট পরিবারের কর্তা এবং কর্ত্রী দু’জনই চাকরিজীবী। তাই তাদের বাসার বাইরে থাকতে হয়। ঘরের এবং শিশুদের দেখাশোনার পুরো কাজটি গৃহকর্মীদেরই করতে হয়। বর্তমান সমাজবাস্তবতায় গৃহকর্মীরা পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের সহযোগিতায় আমাদের পরিবার সচল এবং ছন্দবদ্ধভাবে চলতে থাকে। কিন্তু তাদের পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক খুবই কম। বাসাবাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও একচোখা নীতি দেখা যায়। বাসাবাড়িতে অনেকে কুকুর-বিড়াল পোষেণ। কুকুর ও বিড়ালের যেভাবে যত্ন নেন, ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর রাখেন, তার ছিটেফোঁটাও গৃহকর্মীর বেলায় দেখা যায় না। আমরা গৃহকর্মীর ভালো-মন্দের ব্যাপারে উদাসীন। অথচ গৃহকর্মী পরিবারেরই অংশ। বাসার যে জায়গাটা সবচেয়ে বেশি বিদঘুটে অন্ধকার, আলো বাতাসের সুবিধা নেই, এমন জায়গায় তাদের থাকতে দেয়া হয়। সেখানে একজন মানুষ কষ্ট করে হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু হাত-পা ছড়িয়ে একটু আরাম করে ঘুমানোর সুযোগ নেই। আমরা যে সময় গভীর ঘুমে বিভোর থাকি ঠিক সে সময় ভোরবেলা তাদের উঠে আমাদের অফিসের জন্য খাবার তৈরি করতে হয়। ছেলে ময়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করতে হয়। অথচ আমরা তাদের সাথে একটু সুন্দর ব্যবহার করতে পারি না। বরঞ্চ সামান্য একটু এদিক-সেদিক হলেই অকথ্য গালিগালাজ ও শারীরিক নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। ভালো ব্যবহার, ভালো খাবার, একটু ভালো কাপড়চোপড়, অসুস্থতার জন্য চিকিৎসাটুকু তারা পান না। শুধু কি তাই! এক দিন, এক মাস কিংবা ৩৬৫ দিনেও তাদের ভাগ্যে ছুটি জোটে না। এরপরও তাদের নির্যাতনের অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
তারা আমাদের ভালো থাকতে সাহায্য করেন। পরিবর্তে তাদের ভাগ্যে জোটে অবহেলা। নির্যাতনের যন্ত্রণা সইতে হয়, অনেকসময় শিকার হতে হয় যৌন হয়রানির। আইন ও সালিশকেন্দ্র (আসক) চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩৮ জন নারী গৃহকর্মীর সহিংসতার কথা বলেছে। তাদের মধ্যে ১২ জন নিহত আর তিনজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০২০ সালে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪৫ জন ও হত্যার শিকার হয়েছেন ১৩ জন। ধর্ষণের শিকার আটজন। আরেক হিসাবে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে এক হাজার ৭০টি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৫৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমরা কেন জানি ভুলে যাই তারাও মানুষ। আমাদের মতোই তাদের পেছনে ফেলে আসা সংসার ও পরিবার রয়েছে। পরিবারের প্রতি রয়েছে মমত্ববোধ। আমাদের মতোই তাদেরও রয়েছে মানবিক অনুভূতি। তাদেরও সুখ-দুঃখের চেতনা রয়েছে, রয়েছে হাসি-কান্না-আনন্দ-উল্লাসবোধ। জীবন প্রবাহের গতিধারায় আমরা সবাই সমান। জীবন-মৃত্যুর চক্রে কে গৃহকর্তা কে গৃহকর্মী ভেদাভেদ করে না। আমরা গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, যা ইসলামের দৃষ্টিতে তো বটেই, সাধারণ মানবিক দৃষ্টিতেও গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে কত গৃহকর্মী রয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে এ সংখ্যা প্রায় ২০ লাখের কাছাকাছি হবে বলে ধারণা করা হয়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলওর এক প্রতিবেদন বলছে, সারা বিশ্বে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় প্রায় ৫৩ মিলিয়ন (পাঁচ কোটি ৩০ লাখ)। এর মধ্যে ৮৩ শতাংশই নারী। তবে প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে তাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু গৃহকর্মীর সংখ্যা আইএলওর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। ইতোমধ্যে এ সংখ্যা নিশ্চয় কয়েক গুণ বেড়েছে।
গৃহকর্মীরাও মানুষ; এটি আমাদের স্বীকার করতে হবে। মানুষ হিসেবে স্রষ্টার কাছে সবাই সমান। সাদা-কালো, ধনী-গরিব, এর কোনো প্রকারভেদ আল্লাহ করেননি। আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদাই সবচেয়ে বেশি, যারা সৎকাজ করে ও ভালো কাজের আদেশ দেয়। তারা আমাদেরই পরিবারের অংশ। অথচ আমরা তাদের মর্যাদা দিতে চাই না। আমরা তাদের বুয়া বলে ডাকি। এটি আমাদের সমাজে একটি হীনবাচক শব্দ। অনেক পরিবারে তাদের খালা বলে ডাকা হয়। এটি মার্জিত এবং সামাজিকভাবে গ্রহণীয় একটি শব্দ। তাদের খালা বলে সম্বোধন করতে কোনো অসুবিধা নেই। বুয়া ডেকে তাদের মানসিকভাবে হেয় করার অধিকার কারও নেই। তারা অর্থের বিনিময়ে শ্রম দেন। এ অর্থের পরিমাণ তাদের শ্রমের তুলনায় অনেক কম। সুতরাং কোনো না কোনোভাবে তাদের মর্যাদা দিতে হবে, হয় আর্থিকভাবে নতুবা সামাজিকভাবে। গৃহকর্মী নির্যাতনকারীরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তারা যেন রেহাই না পান বিষয়টি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। সরকার গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি-২০১৫ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এটি বাস্তবায়িত হয়নি। এটি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। নীতিমালা থাকার পরও যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে এক দিকে যেমন তাদের কাজ পেশা হিসেবেস্বীকৃতি পাচ্ছে না, অপর দিকে তারা নানাভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত হচ্ছে। সুবিচার পাচ্ছেন না। ফলে কর্মস্থলে তাদের অমানবিক জীবন কাটাতে হচ্ছে।
গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার স্বাথে গৃহকর্মী নিবন্ধন চালু করা প্রয়োজন। এটি করতে পারলে তাদের সংখ্যা, বয়স, ঠিকানা সবই জানা যাবে। তারা ছুটি পাচ্ছেন কি না, নিয়মিত বেতন পাচ্ছে কি না- তা-ও জানা যাবে। এ ছাড়াও নিবন্ধন করা হলে একজন গৃহকর্মী সুরক্ষা পাবেন। কোনো গৃহকর্তা অপরাধ করে থাকলে তা-ও দ্রুত শনাক্ত করা যাবে। সর্বোপরি আমাদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরির্বতন করা জরুরি। আমরা যদি গৃহকর্মীদের সামাজিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারি তাহলে আমাদের পরিবার ও সমাজ উপকৃত হবে। সুন্দর স্বাভাবিক গতিশীল একটি সমাজ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে গৃহকর্মীদের মর্যাদা- আমাদের মর্যাদাকেই সমুন্নত করবে।