সম্প্রতি সৌদি আরব দেশটির মসজিদে জুমার খুতবায় তাবলিগের বিরোধীতা করে কিছু আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছে। যার প্রেক্ষিতে মুসলিম উম্মাহ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। এ বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
এক. প্রথমত মনে রাখতে হবে, সৌদি আরব কোনো ইসলামি রাষ্ট্র নয়। মুহাম্মদ বিন সৌদ নামের এক ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র মাত্র। যারা জবরদস্তিমূলক নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মভূমিকে দখল করে রেখেছে। হাদিসে যে রাষ্ট্রকে ‘জাজিরাতুল আরব’ বলা হতো, সেই রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে নিজেদের পৈত্রিক সম্পদে পরিণত করেছে এই সৌদ রাজবংশ।
এরা নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য ইসলামের ইতিহাসের সর্বশেষ খেলাফত ব্যবস্থা ‘উসমানি খেলাফত’-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ক্ষমতার লোভে উসমানি খেলাফতের বিরুদ্ধে বৃটিশদের সহযোগী শক্তিতে পরিণত হয়। অবশেষে বৃটিশ অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য সহায়তায় খেলাফতে উসমানিয়ার বিরুদ্ধে তথাকথিত বিজয় অর্জন করে ‘সৌদ’ রাজ পরিবার শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে।
এর মানে অত্যন্ত পরিষ্কার, এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে মুসলমানদের রক্তের ওপর। প্রতিষ্ঠা হয়েছে ইসলামি খেলাফতের বিরুদ্ধে। সুতরাং এ পরিবারের শাসন থেকে ইসলামের কোনো মৌলিক উপকার, সেবা আশা করাটা যথার্থ হবে বলে মনে করি না।
দুই. কোরআন ও হাদিসে স্পষ্ট নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আরবের পবিত্র মাটিতে খ্রিস্টানদের ঘাঁটি করার সুযোগ করে দিয়েছে এ সৌদ সরকার। যেহেতু ক্ষমতায় টিকে থাকাই তাদের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যকে ঠিক রেখে হারামাইনের সৌন্দর্য বর্ধনকে তাদের বিশাল খেদমত হিসেবে পেশ করলেও এটা আসলে তাদের বাৎসরিক একটি ইনকামের সোর্স ছাড়া আর কিছু নয়।
তিন. মুসলিম উম্মাহের উপকারে তাদের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে কোনো প্রকার কার্যকরী পদক্ষেপ এ পরিবার থেকে পরিলক্ষিত হয়নি। বরং ইঙ্গ-মার্কিন স্বার্থ সুরক্ষা করতে মুসলমানদের মাঝে বিবাদ উসকে দেওয়া এবং সেই সুযোগের নিজেদের প্রভাব সৃষ্টি করাই তাদের মূল কূটনীতি।
এরা না নিরীহ ইরাকের পাশে দাঁড়িয়েছে। না শক্তভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বরং এখন ইসরায়েলের মতো অত্যাচারীদের সঙ্গে গোপন আঁতাত এখন প্রকাশ্যে আঁতাতে রূপ দিতে চেষ্টা করছে।
তবে একথা ঠিক, সৌদ পরিবারের মাঝে দু’একজন ভালো শাসক এসেছে। তাদের মাঝে কিছুটা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগই ইহুদি-খ্রিস্টানদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে গেছে এবং যাচ্ছে। বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান এর ধারাবাহিকতায় ষোলোকলা পূর্ণ করার পথে।
চার. যেহেতু সৌদ পরিবার ইসলাম ও মুসলমানদের কোনো প্রতিনিধি নয়। তাদের কথায় না মুসলমান চলে, না ইসলাম চলে। তাই তাদের কথা ও ঘোষণার মাধ্যমে মুসলমানদের কোনো কিছু যায় আসে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।
পাঁচ. ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে সৌদি আরবে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের কোনো সুযোগ কারও নেই। কোনো বিষয়ে মত প্রকাশ করলেই গুম কিংবা জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়। এ কারণে সৌদি আরবের মসজিদগুলোর খতিবরা মূলত সৌদ পরিবারের বেতনভূক্ত সেবক ছাড়া আর কিছু নয়। কোরআন-হাদিস থেকে সঠিক কথা বলার মতো সৎ সাহস তাদের নেই বললেই চলে।
ছয়. যে দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে সিনেমা হল উদ্বোধন হয়। অশ্লীলতায় ভরপুর হলিউড সিনেমা থেকে নায়ক, নায়িকা, গায়ক আমদানি করে সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা আসে। গানের কনসার্ট হয়। বেগানা নারীদের শরীর প্রদর্শনমূলক ফ্যাশন শো হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। সেই দেশে তাবলিগ জামাতের মতো খালিস দ্বীনী দাওয়াতি প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করতে চেষ্টা হবে- এটাইতো স্বাভাবিক।
মানুষ দাওয়াতের মাধ্যমে দ্বীনের পথে আসলে, ইসলামের পথে আসলে ক্ষমতাসীনদের ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ মানুষে মেনে নেবে না। তাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হবে। সৌদ পরিবারের রাজতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। এ কারণে এ দাওয়াতি কার্যক্রম তাদের জন্য হুমকি।
সাত. আগেই বলেছি, ব্যতিক্রম দুই একজন থাকলেও সৌদি আরবের উলামা ও খতিবগণ রাষ্ট্রের সেবাদাস ছাড়া কিছু নয়। এরা ইসলামের প্রকৃত সেবক হওয়ার চেয়ে রাষ্ট্রের সেবাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এ কারণে সৌদ রাজ পরিবারের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের কোনো প্রতিবাদ করার মতো শক্তি-সাহস তাদের নেই।
আট. বিবেকের মাথা খেয়ে সৌদ সরকার তাবলিগ জামাতের ওপর কয়েকটি নিকৃষ্ট মিথ্যাচার করেছে। যথা-
ক. তাবলিগ জামাত নববী দাওয়াতি পদ্ধতি লঙ্ঘন করেছে, তাই তারা বেদআতি।
খ. কালেমার অর্থ বিকৃত করে এবং তারা কবরপূজা করে।
গ. তারা সুফিবাদের মতো বায়াত গ্রহণ করে।
ঘ. তারা সন্ত্রাসী।
ঙ. মাসে তিনদিন, বছরে এক চিল্লা-তিন চিল্লা ইত্যাদি শরিয়তে নতুন সংযোজন। তাই এসব কিছুই বেদআত।
দাওয়াত ও তাবলিগ জামাতের সঙ্গে যার ন্যুনতম কোনো সম্পর্ক আছে তারাই জানেন, এসব অভিযোগ কতোটা হাস্যকর ও ঘৃণিত মিথ্যা।
কবরপূজা, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে তাবলিগ জামাতের কোনো দূরতম সম্পর্ক নেই। অথচ এমন মিথ্যা বলতে কোনো একজন খতিবের গলা একবারও কেঁপে উঠেনি! নবীজী (সা.) নিজেই গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার ও আল্লাহর আনুগত্য করার ওপর সাহাবায়ে কেরাম থেকে বায়াত নিয়েছেন। সুতরাং এটিকে সুফিবাদের বেদআতি আমল বলা হাদিস সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক।
যারা তাবলিগের তিন দিন, এক চিল্লার বিরোধীতা করে গলা ফাটালেন, তাদের কখনও এ বিষয়ে ফতোয়া দিতে দেখিনি যে, আল্লাহর নবী দ্বীন শেখানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেননি। এমএ, বিএ, মাস্টার্স আর পিএইচডি করার পদ্ধতি আবিস্কার করেননি। এখন দ্বীন শিক্ষার নামে মদিনা ইউনিভার্সিটি, কিং সৌদ ইউনিভার্সিটি এসব পদ্ধতি আবিস্কার করে নববী ইলম শিক্ষার পদ্ধতি লঙ্ঘন করছেন। এসব বেদআতি পদ্ধতি পরিত্যাগ করতে হবে। তাবলিগ জামাতের লোকদের দাওয়াত শেখার ও দেওয়ার পদ্ধতি তিন দিন-একচিল্লা, তিনচিল্লা পদ্ধতি বেদআত হলে দ্বীন শিক্ষার পদ্ধতিতে একাডেমিক পদ্ধতি কেন বেদআতের অন্তর্ভুক্ত নয়?
নয়. দ্বীনে হক ছিল, আছে, থাকবে- কেয়ামত পর্যন্ত ইনশাআল্লাহ। কোনো জালেম শাসকের ফতোয়াবাজীর কারণে দ্বীনে হক ধ্বংস হবে না। সুতরাং সৌদ সরকারের এমন বিধি-নিষেধে হিম্মত হারানোর কিছু নেই।