স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। এ অধিকার যে কত বড় মাপের, তা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধরাই কেবল অনুধাবন করতে পারেন। মহান আল্লাহ তা খর্ব করার অধিকার দেননি কাউকে। ইসলামের শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠিত এ অধিকার খর্ব করা যেমন মানবাধিকার পরিপন্থী; তেমনি মহান আল্লাহর আইনের বিরোধীও বটে। শান্তির ধর্ম ইসলাম গতানুগতিক কোনো স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে আসেনি, বরং বিশ্ব মানবতার সামগ্রিক জীবনে মুক্তি, সাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার বাস্তব কর্মসূচি দিয়ে মানুষকে সৎপথে চলার দিক-নির্দেশনা দিতে এসেছে।
মানুষের বহুরূপ দাসত্ব-শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে ইসলাম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বিশ্বাসের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা এবং সমালোচনা সবক্ষেত্রেই ইসলাম এই স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলাম মানুষকে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বাধীনতা দিয়ে মানব অস্তিত্বে স্বাধীনতার বীজবপন করে দিয়েছে। ইসলাম মানুষকে সঠিক পথ প্রাপ্তির জন্য কোরআন নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছে।
ইসলাম প্রতিটি নাগরিককে জাতীয়, আঞ্চলিক এমনকি ব্যক্তিগত বিষয়েও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। এ অধিকার উপেক্ষা করে যুগে যুগে কিছু পাপাচারী স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে পরোক্ষভাবে নাগরিক জীবনকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে দেশে দেশে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মানুষের জন্য আনন্দের দিন। আমাদের বিজয় দিবস। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো, তার ভূখন্ড, মাতৃভূমিকে ভালোবাসা। এটাই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম আদর্শ। নবী করিম (সা.) যখন মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগ করে পাড়ি জমাচ্ছিলেন ইয়াসরিবের (মদিনার পূর্বনাম) প্রতি, তখন তার চোখ থেকে অশ্রুর বন্যা বয়ে যাচ্ছিল এবং মনে মনে বলেছিলেন, হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাফেররা নির্যাতন করে যদি আমাকে বের করে না দিত, কখনও আমি তোমাকে ত্যাগ করতাম না। -ইবনে কাসির : ৩/৪০৪
হাদিসের বর্ণনায় আছে, নবী করিম (সা.) মদিনাকে খুব ভালোবাসতেন। কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্তে ওহুদ পাহাড় চোখে পড়লে নবীজীর চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত এবং তিনি বলতেন, এই ওহুদ পাহাড় আমাদেরকে ভালোবাসে, আমরাও ওহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি। -সহিহ বোখারি : ২/৫৩৯
ইসলামে স্বাধীনতার মর্ম
ইসলাম রক্তপাত, হানাহানি, মারামারি, হত্যা অথবা ইসলাম গ্রহণে জবরদস্তির অনুমোদন দেয় না, কিন্তু অন্যায়, হত্যা, স্বাধীনতা হরণ প্রতিরোধে যুদ্ধ করতেও নির্দেশ দেয়। নিজ দেশকে পরাধীনতামুক্ত রাখতে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগে নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কেননা, কোনো জুলুমকেই প্রশ্রয় দেয় না ইসলাম। জালেমদের খপ্পর থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে লড়াই করার তাগিদ দিয়েছে কোরআন। জুলুম ও শোষণমুক্ত, আল্লাহদ্রোহী মানসিকতামুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে কল্যাণরাষ্ট্রে অক্ষুণ্ণ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম।
স্বাধীনতার সীমারেখা
ইসলাম স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও সে স্বাধীনতা বল্গাহীন স্বাধীনতা নয়। সে স্বাধীনতা কিছু বিধি-নিষেধ দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত। ইসলামে স্বাধীনতা হচ্ছে, নিজেকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করা।
ইসলাম মানুষকে রাজনীতির অধিকার দিয়েছে, কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরতান্ত্রিকতাকে মোটেও প্রশ্রয় দেয়নি। দলের ঊর্ধ্বে উঠে ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, দুর্বল-সবল সবার প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। বস্তুত দেশপ্রেম ও জাতিপ্রেমের কোনো বিকল্প নেই। দেশের প্রচলিত (ইসলামবিরোধী নয় এমন) দেশীয় পণ্যকে প্রাধান্য দেওয়া, জাতীয় সম্পদের সুরক্ষা, অপচয়রোধ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ইত্যাদি বিষয় হলো- দেশপ্রেমের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এসব বিষয়ের প্রতি প্রতিটি নাগরিককে যেমন সজাগ থাকতে হবে, তেমনি শাসকদেরও এর প্রতি যত্নশীল হতে হবে।
কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে করণীয়
বিজয় দিবস সম্পর্কের আলোচনায় কোরআনে কারিমের দু’টি সুরা আমাদের সামনে পড়ে। একটি সুরা ‘ফাতাহ’(বিজয়), আরেকটি সুরার নাম সুরা ‘আন নাসর’ (মুক্তি ও সাহায্য)। কোরআনে কারিমের সুরা নাসরে বিজয় দিবসের তিনটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
১. এই দিনে তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও বড়ত্ব বর্ণনা করা।
২. আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা।
৩. মুক্তিযুদ্ধের সময়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, জেহাদ চলাকালীন সময় যদি ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে, তার জন্য আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা চাওয়া।
বিজয় দিবসের করণীয় সম্পর্কে নবী (সা.)-এর আদর্শ
যে মক্কা নগরী থেকে নবী করিম (সা.) বিতাড়িত হলেন, ১০ বছর পর শত-সহস্র সাহাবার বিশাল বহর নিয়ে যখন মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি বিজয় মিছিল-শোভাযাত্রা কিছুই করেননি। গর্ব-অহংকার করেননি, বাদ্য-বাজনা বাজাননি। নবীজীর অবস্থা কি ছিল? আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওযি (রহ.) (মৃত ৫৯৭) ‘যাদুল মাআদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আল্লাহর নবী একটি উটের ওপর আরোহণ অবস্থায় ছিলেন, তার চেহারা ছিল নিম্নগামী। (অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে বিনয়ের সঙ্গে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন) সর্বপ্রথম তিনি উম্মে হানীর ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এই নামাজকে বলা হয়- ‘বিজয়ের নামাজ।’
এরপর নবী করিম (সা.) হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, হে মক্কার কাফের সম্প্রদায়! তের বছর ধরে আমার ওপর, আমার পরিবারের ওপর, আমার সাহাবাদের ওপর নির্যাতন তোমরা চালিয়েছ, এর বিপরীতে আজকে তোমাদের কি মনে হয়, তোমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব? তারা বলল, হ্যাঁ; আমরা কঠিন অপরাধী। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আপনি আমাদের সঙ্গে উদারতা, মহানুভবতা প্রদর্শন করবেন। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। নবী করিম (সা.) বললেন, হ্যাঁ; আমি আজ তোমাদের জন্য হজরত ইউসুফ (আ.)-এর মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। যাও তোমাদের থেকে কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। -সুনানে বায়হাকি : ৯/১১৮
এখানেই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, অনবদ্যতা, অনন্যতা। শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা বিজয় করে নবী করিম (সা.) পুরো বিশ্বকে এই বার্তা দিলেন, আমরা শান্তির পক্ষে এবং লুন্ঠনের বিপক্ষে। সুতরাং বিজয় দিবসে আমাদের করণীয় হলো-
১. বিজয়ের আট রাকাত নামাজ আদায় করা,
২. শত্রুর প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করা ইত্যাদি।