নির্দিষ্ট একটি বহমান সময়ের ধরাবাঁধা শৃঙ্খলের নাম জীবন। এর বাইরে মানুষ চাইলেও, যাওয়ার সাধ্য নেই। মানুষ যখন পৃথিবীতে আসে, তখন সে থাকে খুবই দূর্বল, অবুঝ আর অক্ষম। অন্যের সাহায্য ছাড়া সে একফোঁটা মায়ের দুধও পান করতে পারে না। এমনই অসহায় থাকে মানুষ শিশুকালে। ধীরে ধীরে মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় শিশুর মুখে বুলি ফোটে। হাঁটতে শেখে অন্যের হাত ধরে। জীবন চলার পথ এমনই কঠিন।
আমরা যখন জীবনে বুঝার বয়সে পা রাখি, তখন কতই না আমাদের অহমিকা, দাম্ভিকতা আর জ্ঞানের বাহাদুরি হৃদয়ে জন্মে। চলাফেরায় বেশভূষণে অপার অহমিকা-আভিজাত্য প্রকাশ পায়। মানুষ তখন সৃষ্টিজগতের সবকিছুই তার পায়ের তলায় মনে করে। ধরাকে মনে করে এ তাদের কাছে কিছুই না। মানুষ এতটাই অকৃতজ্ঞ, যা পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বারবার বলেছেন। তার সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ প্রতিনিয়ত তার অবাধ্যতা করতে থাকে, তবুও তিনি ক্ষমা করে দেন; মানুষ কাঁদলে স্বীয় কৃতকর্মের অনুশোচনায়।
শৈশব, কৈশোর আর যৌবন পেরিয়ে মানুষ একসময় ফের বার্ধক্যে পৌঁছে। মুখাবয়ব হয়ে পড়ে কদাকার আর বলি রেখায় ভরপুর। বার্ধক্য রূপটার বাহ্যিক সৌন্দর্যটা খুবই কুৎসিত হয়। একটা মেশিন চলতে চলতে একসময় পুরোনো হয়ে নাট-বল্টু যেমন পড়ে গিয়ে নড়বড়ে হয়ে যায়, তেমনি হয়ে যায়- মানুষের শরীর মন। এরপরও অহংকার করার মত কিছু থাকে কি?
বয়সের ভারে নুইয়ে পড়ে ধন-সম্পদের পেছনে মরিয়া হয়ে ছুটে চলা মানুষগুলো তখন প্রিয়জন থেকে সহস্র মাইল দূরে থাকে। কারণ সুখের সময়ে তারা ছিল উচ্চবিলাসী, দাম্ভিক আর ধরাছোঁয়ার বাইরে। গরীব আত্মীয়-স্বজন থাকে ধনীদের চোখের বালি। রমরমা ব্যবসায় তখন মা-বাবা, ভাই-বোন হয়ে পড়ে অচ্ছুৎ। আর বাইরের লোক হয় লাভের মনোহরী উপাদান।
মানুষ জন্মের সময় যেমন একা আসে, তেমনি মৃত্যুর সময়ও একা হয়ে পৃথিবী ছাড়ে। তখন তার ধন-সম্পদের পাহাড় থাকলেও তা কোনো কাজে আসে না। মানুষ বিবস্ত্র হয়ে পৃথিবীতে আসে, আবার বিবস্ত্র হয়েই যেত- যদি না সাদা কাফনটা না দেওয়া হত। মানুষের জন্মের পর গোসল যেমন অন্যের হাতে হয় তেমনি মৃত্যুর পরও তার শেষ গোসল অন্যরা দেয়। তাহলে কীসের এত বাহাদুরি, অহংকার, মারামারি, হানাহানি আর বেঈমানির প্রয়োজন পড়ে মানুষকে? অথচ ক্ষণস্থায়ী এ জীবনটা হতে পারে কতই না সুন্দর অর্থবহ!
মানুষের মতো বুদ্ধিমান জীব আরেকটি নেই। পুরো পৃথিবী শাসন করার ক্ষমতা মানুষের হাতে ন্যস্ত। কিন্তু ক্ষমতার লোভ, অর্থের লিপ্সা, কামাতুর বাসনা মানুষকে অধপতনের দিকে নিয়ে যায়।
মানুষ চাইলেই জীবনকে অর্থবহ সুন্দর ব্যাখ্যায় চালাতে পারে। কেবল নিয়মিত নিজেকে অনুশাসনে রাখা, অন্যের দুষ্ট বুদ্ধি বোঝার ক্ষমতা প্রজ্জ্বলিত হলে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আর ভুল করলে তার অনুতপ্তের নিরেট স্বীকারোক্তি নিজের কাছে হওয়া চাই। বাইরের লোক কে, কী বলল তা কোনো বিষয় নয়। কারণ মানুষ তার কর্মফল নিজেই ভোগ করে আর পাপ পূণ্যের ভাগিদার হয় তার পরিবার। কষ্ট বা সুখ অনুভব করে একান্তই তার পরিবার-পরিজন। বাকিরা হাততালি দেয়। অসহায় হয়ে পড়লে করুণা দেখায়। কখনোই সহমর্মিতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহায্যের হাত বাড়ায় না।
তাহলে জীবনের অর্থ কী দাঁড়াল? আসছি একা আর যাব একাই। কেউ কারও স্মৃতিতেও একসময় না-ই হয়ে যাব, তাহলে কী দরকার এতই দুনিয়ার প্রতি লোভ করে?
জীবনের অর্থ হবে যেহেতু নির্দিষ্ট একটি সময়সীমায় আমরা বেঁচে থাকব আর কখন তা শেষ হবে হুট করে জানিও না। তখন জীবনকে ভালো কাজেকর্মে, ন্যায়ের পথে পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, অসহায়ের পাশে প্রতিবিম্ব হয়ে দাঁড়ানোর নামই হলো- জীবন। আমরা মানুষ বিবেক দিয়ে চললে ধীরে ধীরে পাপমোচন হবেই হবে। স্রষ্টাও ক্ষমা করবেন তার সৃষ্টির অনুতাপ সত্যিকার দেখলে। তিনি তো সবার মনের ভেতরের বাইরের সব খবর জানেন এবং রাখেন সর্বদা। তাহলে ভয় কী আমরাতো তার কাছেই ফিরব ফের। তাই পবিত্র হয়ে ফিরতে হবে তার কাছে আত্মার বিশুদ্ধতায়।
শেষ দিনটি জীবনের যেন প্রিয়জনের সান্নিধ্য নিয়ে মরা যায় তাই হওয়া উচিত জীবনের চরম উপজীব্য। অর্থবিত্ত, সুনাম আর গাড়ি-বাড়ী মৃত্যুর সময় অহেতুক মনে হবে, কেবল রক্ত মাংসের মানুষের ভালোবাসার ভালোলাগার অনুভূতির স্পর্শ তখন পরম শান্তি দেবে। আসুন, সকলের মাঝে নিঃস্বার্থ, নির্লোভ আর মোহহীন ভালোবাসা ও মায়া ছড়াই।