পবিত্র কোরআন-হাদিসের বর্ণনানুযায়ী জানা যায়, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সশরীরে বোরাকে আরোহণ করে হজরত জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে মসজিদে হারাম থেকে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাস (বায়তুল মাকদাস) পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। নবী করিম (সা.) সেখানে মসজিদের খুঁটির সঙ্গে বোরাক বেঁধে যাত্রাবিরতি করেন এবং সব নবীর ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করেন।
পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ -সুরা বনি ইসরাইল : ১
পবিত্র হাদিসে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখতে পাই। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, মেরাজ শেষে যখন আমি মক্কায় ফিরলাম, তখন আমার ধারণা হলো, এ ঘটনা বর্ণনা করলে মানুষ আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে এবং তারা এটা অস্বীকার করবে। এরপর হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) চিন্তিত হয়ে বসে থাকলেন। আল্লাহর দুশমন আবু জেহেল তার কাছ দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেখে তার কাছে গিয়ে বসল এবং বিদ্রূপের স্বরে সে তাকে জিজ্ঞেস করল- ওহে, তোমার নতুন কিছু হয়েছে কি? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, হ্যাঁ।
সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, রাতে আমাকে ভ্রমণ করানো হয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল, কোন পর্যন্ত? তিনি বললেন, বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত। আবু জেহেল বলল, বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করে আবার তুমি আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন সে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথা অস্বীকার করা সমীচীন মনে করল না, কারণ তার আশঙ্কা হলো, মানুষের সমাবেশে হয়তো তিনি এ কথা অস্বীকার করে ফেলবেন।
তখন সে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আমি যদি তোমার কওমকে ডেকে একত্র করি, তবে তাদের সামনেও কি তুমি এ কথা বলবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন সে উচ্চস্বরে ডাক ছাড়ল, হে বনু কাব ইবনে লুওয়াই গোত্রের লোকেরা! তার এ চিৎকার শুনতেই সবাই সেখানে জড়ো হলো। আবু জেহেল বলল, তুমি আমাকে যে কথা বলেছ, এখন সবার সামনে তা বলো। তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমাকে রাতে ভ্রমণ করানো হয়েছে। তারা জিজ্ঞাসা করল, কোন পর্যন্ত? তিনি বললেন, বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত।
তারা বলল, বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করে আবার তুমি আমাদের মাঝে ফিরে এসেছ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এ কথা শুনে বিস্ময়াভিভূত হয়ে কেউ কেউ তালি বাজাতে লাগল, আর কেউ কেউ মিথ্যা কথা মনে করে মাথায় হাত দিয়ে বলল- আচ্ছা, তুমি কি বায়তুল মোকাদ্দাসের কিছু অবস্থা বলতে পারো? তাদের মধ্যে কিছু লোক এমন ছিল, যারা বায়তুল মোকাদ্দাস ভ্রমণ করেছে এবং মসজিদও দেখেছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি বায়তুল মোকাদ্দাসের বর্ণনা দিতে লাগলাম; কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে আমার সন্দেহ হতে লাগল। আল্লাহতায়ালা নিজ কুদরতে বায়তুল মোকাদ্দাসকে আমার সামনে হাজির করে দিলেন এবং তাকে আকিলের ঘরের কাছে রেখে দিলেন আর আমি তা দেখে দেখে তার অবস্থা বর্ণনা করতে লাগলাম। এ ব্যবস্থা এ কারণে করা হয়েছিল যে মসজিদের কোনো কোনো অবস্থা আমার মনে ছিল না। তখন তারা বলল, আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ (সা.) তো বায়তুল মোকাদ্দাসের সব অবস্থা ঠিক ঠিক বর্ণনা করেছে। ইমাম নাসাই আওফ ইবনে আবু জামিলা থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।
আকসা মসজিদের দরজা আটকে যাওয়ার ঘটনা
হাফিজ আবু নুয়াইম ইস্পাহানি দালায়েলুন নবুওয়ত গ্রন্থে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রোম সম্রাট হিরাকলের কাছে হজরত দাহ্ইয়া কালবি (রা.)-কে দূত হিসেবে প্রেরণ করলেন। তিনি হিরাকলের কাছে পৌঁছলেন। এরপর হিরাকলে সিরিয়ায় অবস্থানরত আরবের ব্যবসায়ীদের ডাকলেন। আবু সুফিয়ান দুখর ইবনে হারবকে ও সঙ্গীদের হাজির করা হলো। এরপর তিনি সেসব প্রশ্ন করলেন, যার উল্লেখ বোখারি ও মুসলিম শরিফে রয়েছে।
আবু সুফিয়ান হিরাকলের সামনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হেয়প্রতিপন্ন করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন। তিনি নিজেই বলেন, আল্লাহর কসম! হিরাকলের সামনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হেয়প্রতিপন্নকারী কোনো কথা বলতে এই ভয় ছাড়া অন্য কোনো জিনিস আমাকে বাধা দেয়নি যে হয়তো তার সামনে আমার মিথ্যা ধরা পড়ে যাবে এবং তার কাছে আমার আর কোনো কথাই গ্রহণযোগ্য হবে না। এমন সময় হঠাৎ তার মেরাজের কথাটি আমার মনে পড়ল এবং বললাম, সম্রাট! আপনাকে আমি এমন একটি খবর কি দেব না, যা আপনার কাছে তার মিথ্যা প্রমাণিত হবে? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সেটা কি? তখন আমি বললাম, তিনি বলেছেন, তিনি আমাদের ভূখণ্ড মসজিদে হারাম থেকে আপনাদের মসজিদে ইলিয়া পর্যন্ত একই রাতে ভ্রমণ করে ভোর হওয়ার আগেই ফিরে গেছেন।
আবু সুফিয়ান বলেন, আমার কথা শোনামাত্রই বায়তুল মোকাদ্দাসের পাদরি বলে উঠলেন, এটা সম্পূর্ণ সত্য। তখন রোম সম্রাট কায়সার তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এটা কিভাবে জানেন? তিনি বললেন, আমি মসজিদের দরজাগুলো বন্ধ করার আগে ঘুমাতে যাই না। কিন্তু সেই রাতে একটি দরজা ছাড়া সব দরজা আমি বন্ধ করে দিই। কিন্তু ওই দরজাটি আমি কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারিনি। তখন আমি আমার অন্যান্য কর্মচারী ও উপস্থিত লোকজনের সাহায্য নিলাম। কিন্তু সবাই জোর খাটিয়েও দরজা তার স্থান থেকে সরাতে পারল না। যেন কোনো পাহাড় সরাচ্ছি বলে মনে হলো। আমি মিস্ত্রি ডাকলাম, তারাও এটা খুব লক্ষ করে দেখল, কিন্তু কোনো উপায়েই তা সরাতে পারিনি এবং সকাল পর্যন্ত মুলতবি রইল।
পাদরি বলেন, আমি দরজাটি খোলাই রেখে দিলাম। ভোরে যখন দরজার কাছে এলাম, তখন মসজিদের পাশে পড়া পাথরটিতে ছিদ্র দেখলাম এবং এতে কোনো পশু বাঁধার চিহ্নও দেখতে পেলাম। তখন আমি আমার সঙ্গীদের বললাম, আজ রাতে কোনো নবীর আগমনের জন্যই দরজাটি খোলা রাখা হয়েছিল এবং এই মসজিদে অবশ্যই তিনি নামাজ পড়েছেন। -সূত্র : তাফসিরে ইবনে কাসির