স্থানীয়দের কাছে মসজিদটি কালাপাহাড় নামে পরিচিত হলেও দেশব্যাপী পরিচয় কুসুম্ব মসজিদ নামে। এটি নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার পশ্চিমে মান্দা উপজেলার নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের পশ্চিম পাশে কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত।
মসজিদের প্রবেশদ্বারে বসানো ফলকে মসজিদের নির্মাণকাল লেখা রয়েছে হিজরি ৯৬৬ সাল(১৫৫৮-১৫৬৯খ্রিষ্টাব্দ)। সুলতান গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহের রাজত্বকালে সুলতান সোলায়মান নামে এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং প্রস্থ প্রায় ৪৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। দুই সারিতে ৬টি গোলাকার গম্বুজ রয়েছে। কালো পাথর দিয়ে নির্মিত এই মসজিদটি প্রায় ৪৬৪ বছরের ইতিহাস বহন করে। মসজিদের গায়ে রয়েছে লতাপাতার নকশা। মসজিদটি আয়তাকার এবং এতে রয়েছে তিনটি বে এবং দুটি আইল।
মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোনের স্তম্ভের ওপর একটি উঁচু আসন আছে। ধারণা করা হয়, এই আসনে বসেই তৎকালীন কাজী-বিচারকরা এলাকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিতেন ও বিচার কাজ পরিচালনা করতেন।
মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ। ছয় গম্বুজবিশিষ্ট মূল্যবান কালো পাথর দিয়ে নির্মিত মসজিদটি প্রায় ৪৬৪ বছরের ইতিহাস বহন করে। পাঁচ টাকার কাগজের নোটে এ মসজিদের ছবি মুদ্রিত আছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলাসহ বিদেশি পর্যটকরা মসজিদটি দেখতে আসেন। বছরের দুই ঈদে প্রচুর দর্শনার্থীদের সমাগম হয়।
ঐতিহাসিক এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছর থেকে সেখানে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। এটি জেলার অন্যতম ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্র। যেখানে দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিন পর্যটকরা দেখতে আসেন। মসজিদটিকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কুসুম্বা মসজিদ চত্বরের ডান পাশে বাক্স আকৃতির একটি কালো পাথর আছে। কথিত আছে, জনৈক কৃষক হালচাষের সময় তার জমিতে ওই পাথরটি পায়। পাথরটি লাঙ্গলের ফলার আঘাতে কিছুটা ভেঙে যায়। পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়। উদ্ধারকৃত পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবি লিপি রয়েছে। ‘আল মালিকু মা হুমম মোকাররামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন। অর্থাৎ তিনি শাসক যিনি পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হোসেনের ছেলে আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ।’
এ থেকে বোঝা যায়, পাথরখণ্ডটি হুসেন শাহের স্মৃতিবিজড়িত। মসজিদের কিছু সংস্কারের প্রয়োজন মনে করছেন স্থানীয়রা।
মসজিদের সামনে রয়েছে বিশাল এক দিঘি। কথিত আছে, দিঘির তলদেশে পারদমিশ্রিত থাকায় পানিতে কচুরিপানা বা অন্যকোনো আগাছা জন্মে না। দিঘিতে নামার জন্য দুটি দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি রয়েছে। দিঘির হৃদয় শীতল করা পানিতে দর্শনার্থীরা হাত-মুখ ধুয়ে দূর করেন ক্লান্তি। দিঘির হৃদয় শীতল করা পানিতে অজু করেন মুসল্লিরা। স্থানীয়রা দিঘিতে গোসল করেন।
কুসুম্বা মসজিদের মোয়াজ্জিন মাওলানা ইসরাফিল আলম বলেন, মসজিদে নিয়িমিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত হয়। মসজিদে মেহরাব রয়েছে তিনটি, যার সবগুলো কালো পাথরের তৈরি। মেহরাবে আঙ্গুরগুচ্ছ ও লতাপাতার নকশা খোদিত। মসজিদে নারীদের নামাজ পড়ার আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোনাংশে মহাকালের স্বাক্ষী একটি তেঁতুল গাছ। মসজিদে সামনে রয়েছে প্রায় ৭৭ বিঘা আয়তনের একটি দিঘি। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১ হাজার ২৫০ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় ৯শ ফুট। দীঘিটি সুগভীর এবং স্বচ্ছ জলরাশি।
নওগাঁ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় পুরাতন যেসব মসজিদ রয়েছে সবগুলো একই আদলে এবং একই সময়ে তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে দেশে সরকারি কোনো দপ্তর বা স্থাপনা তৈরি হলে যেমন একই আদলে হচ্ছে। ঠিক তেমনি ওই সময়ে মধ্যযুগে কুসুম্বা মসজিদের ক্ষেত্রেও হয়েছিল। তার অবয়ব এবং গঠন শৈলী তাই প্রমাণ করে।
বদলগাছী পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু বলেন, কুসুম্বা মসজিদ প্রত্নত্বত্ত অধিদপ্তরের সংরক্ষিত পুরাকৃতি। যেখানে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা ঘুরতে আসেন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে ভিড় বেশি হয়। প্রাচীন আদল ঠিক রেখে সংস্কারসহ পর্যটক কিভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি।