অটিজম বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। অটিজম কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। অটিজম মূলত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতাজনিত একটি মানসিক রোগ। এটি মানুষের হরমোনজনিত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ।
ইসলামের ইতিহাসে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পাওয়া যায়, যারা তাদের পূণ্যময় কীর্তির কারণে পৃথিবীতে চিরদিনের জন্য ভাস্কর হয়ে আছেন। কোরআনে কারিমে প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে হৃদ্যতামূলক আচরণ করতে এবং তাদেরকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
প্রাচীন যুগে প্রতিবন্ধীদের উপেক্ষা করা হতো, তাদের সামাজিক মান-মর্যাদা দেওয়া হত না। এমনকি এখনও কিছু সমাজে তা দেখা যায়। কিন্তু নবী কারিম (সা.) সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে তার অনুপস্থিতির সময় মদিনার মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব এক প্রতিবন্ধী সাহাবিকে অর্পণ করে তাদেরকে সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠিত করার নজির তৈরি করেন। তিনি প্রতিবন্ধী সাহাবিকে আজান দেওয়ার কাজেও নিযুক্ত করেছিলেন। সেই সম্মানীয় সাহাবি হলেন- হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)।
প্রতিবন্ধীদের জন্য শরিয়তের বিধান বাস্তবায়নেও ছাড় রয়েছে। অর্থাৎ শরয়ি আদেশ জরুরি নয় কিন্তু ক্ষমতাবানের প্রতি। এই ফিকহি মূলনীতিটির ব্যাখ্যা হচ্ছে, প্রত্যেক ফরজ বিধান যা মহান আল্লাহ মানুষের প্রতি ধার্য করেছেন, যদি মানুষ তা পালনে সক্ষম হয়, তাহলে তার প্রতি তা পালন করা আবশ্যক হবে, সে প্রতিবন্ধী হোক বা অপ্রতিবন্ধী। আর যদি সম্পূর্ণরূপে সে তা বাস্তবায়ন করতে অক্ষম হয়, তাহলে তা থেকে সে মুক্তি পাবে। আর যদি কিছুটা করতে সক্ষম হয় এবং কিছুটা করতে অক্ষম হয়, তাহলে যেই পরিমাণ করতে সক্ষম হবে, সেই পরিমাণ তাকে পালন করতে হবে এবং যেই পরিমাণ করতে অক্ষম হবে, সেই পরিমাণ থেকে সে ছাড় পেয়ে যাবে।
সমাজ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও তাদের ন্যায্য পাওনা সম্পর্কে ইসলাম গুরুত্ব প্রদান করেছে। যেহেতু প্রতিবন্ধীরা শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থ-সামাজিক অক্ষমতা বা অসুবিধার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। তাই তাদের প্রতি দয়া-মায়া, সেবা-যত্ন, সুযোগ-সুবিধা ও সাহায্য-সহায়তার হাত সম্প্রসারণ করা একান্ত কর্তব্য। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো তাদেরও ন্যায্য প্রাপ্য।
বিপদ-আপদে সবসময় প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়ানো ঈমানি দায়িত্ব। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে অসদাচরণ বা তাদের উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা ঠাট্টা-তামাশা করা সৃষ্টিকে তথা আল্লাহকে উপহাস করার শামিল। প্রতিবন্ধীদের সীমাহীন দুঃখ-দূর্দশা উপলব্ধি করতে পারেন সেসব ধর্মপ্রাণ সংবেদনশীল মানুষ, যারা অন্যের দুঃখ-বেদনাকে সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখেন।
ইসলামের আলোকে প্রতিবন্ধীদের পরমুখাপেক্ষিতার পথ থেকে স্বাবলম্বিতার পথে আনার সব রকম প্রচেষ্টা জোরদার করার তাগিদ রয়েছে। নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইকে সাহায্য করে, আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন।’ -সহিহ মুসলিম
কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থায় দুর্বল ও অসহায় এই প্রতিবন্ধী শ্রেণি নানা নিগৃহের শিকার। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সমাজের প্রতিবন্ধী শ্রেণিকে তাদের অধিকার আদায়ের সুযোগ দেওয়া উচিত। তাদেরও মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং স্বাভাবিক সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। পবিত্র ধর্ম ইসলাম প্রতিবন্ধীদের মানবিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত কার্যকরভাবে মানুষকে তাদের প্রতি কর্তব্য-সচেতন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা এসেছে, ‘আর তাদের (বিত্তশালী) ধনসম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক বা অধিকার রয়েছে।’ -সুরা আয যারিয়াত : ১৯
অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা পেলে একজন প্রতিবন্ধীও সুন্দর ও সুস্থভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। অনুকূল পরিবেশ, আর্থিক সহযোগিতা, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে তারাও সমাজ, দেশ ও জাতি গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে পারে। প্রতিবন্ধীদের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক অক্ষমতার জন্য দূরে ঠেলে না দিয়ে তাদের প্রতি অন্যদের মতো সুন্দর আচরণ করা ইসলাম অনুসারীদের মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন। আল্লাহর কাছে প্রিয় সৃষ্টি হলো, যে তার সৃষ্টির প্রতি সদয় আচরণ করে।’
অন্য হাদিসে নবী কারিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে ফল খাওয়াবেন। যে তৃষ্ণার্তকে পানি পান করায়, আল্লাহ জান্নাতে তাকে শরবত পান করাবেন। যে কোনো দরিদ্রকে বস্ত্র দান করে, আল্লাহপাক তাকে জান্নাতে পোশাক দান করবেন।’ -জামে তিরমিজি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিত্বের শিকার। জাতীয় পর্যায়ে জরিপ না থাকায় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা কত তা জানা নেই। তবে এই প্রতিবন্ধিত্বের হার দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই সমাজে যেসব প্রতিবন্ধী আছে তাদের সমাজ, দেশ বা জাতির বোঝা মনে না করে উন্নত প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও কাজের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে তাদের মানবসম্পদে রূপান্তর করার সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। এতে একদিকে যেমন এরা স্বাবলম্বী হতে পারবে, অন্যদিকে দেশীয় অর্থনীতিতেও অনবদ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। আর ইসলাম মানবকল্যাণের ধর্ম হিসেবে সবাইকে প্রতিবন্ধীদের যথার্থ অধিকারের প্রতি সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইকে সাহায্য করে, আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন।’ -সহিহ মুসলিম
আমাদের উচিত প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে সমাজে বিদ্যমান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে ইসলাম তাদের যে সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে তা নিশ্চিত করা।