এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রাচীনকাল থেকে যে যৌথ পরিবারে চিত্র সারাবাংলায় ছিল- তা এখন অনেকটাই ম্লান। শহুরে জীবনে অনেক আগেই বিলীন হয়েছে যৌথ পরিবার। আগে গ্রামে-গঞ্জে কিছু যৌথ পরিবার দেখা গেলেও এখন তা আর নেই। এমনকি ঐতিহ্যবাহী পরিবারেও বিলীন একত্রে বাস করার ইতিহাস। দিন যত যাচ্ছে, আমরা যেন তত এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছি। ক্রমেই ‘স্বামী-স্ত্রী-সন্তানে’ই সীমাবদ্ধ করে ফেলছি পরিবারকে। সেখানে মা-বাবা কিংবা দাদা-দাদীর স্থান নেই। মা-বাবাকে হয় গ্রামের বাড়িতে কাটাতে হচ্ছে নিঃসঙ্গ-অসহায় জীবন। আবার অনেক মা-বাবার ঠিকানা হচ্ছে- ‘বৃদ্ধাশ্রম।’
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একান্নবর্তী কিংবা যৌথ পরিবারের ধারণা এখন ‘সেকেলে’ হয়ে গেছে। বিশেষ করে, শহুরে জীবন ব্যবস্থায় এই ব্যাপারটি চরম আকার ধারণ করেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সমাজে প্রচলিত যৌথ পরিবারে পারস্পরিক সম্প্রীতি গভীর হয়, অসুখ-বিসুখসহ নানা সমস্যায় একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এতে অনেক বড় সমস্যাও সমাধান হয়ে যায় অতিসহজে।
রক্তের বন্ধন মানেই পারিবারিক বন্ধন। পরিবারের সব সদস্যের মাঝে অকৃত্রিম সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তা অটুট রাখা সবার দায়িত্ব। সমাজ ব্যবস্থায় সুন্দর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত হচ্ছে, সুন্দর পারিবারিক বন্ধন।
প্রত্যেক মানুষের জন্য পারিবারিক শিক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো আয়ত্ব করতে পরিবারই সর্বোত্তম মাধ্যম। নানাবিধ চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। ভদ্রতা, নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা, কৃতজ্ঞতাবোধ, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন, কনিষ্ঠদের স্নেহ-আদর, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন, পরোপকারিতার মানসিকতা গড়ে তোলা এবং উদার মানসিকতাবোধ জাগ্রত করার গুণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যতটা না অর্জন করা যায়- তার চেয়ে বেশি পরিবার থেকে অর্জন করা যায়।
পৃথিবীর প্রথম পরিবার গড়ে ওঠে হজরত আদম (আ.) ও তার স্ত্রী হজরত হাওয়া (আ.)-এর মাধ্যমে। পরিবারের সদস্য প্রথমত তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জন ছিলেন। সৃষ্টির পর আল্লাহতায়ালা এ পরিবারকে জান্নাতে বসবাস করতে দেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আদম! তুমি আর তোমার স্ত্রী দু’জনেই জান্নাতে বসবাস করো।’ -সুরা আল বাকারা : ৩৫
এরপর তারা পৃথিবীতে আসেন। তাদের থেকে জন্ম নেয় সন্তান-সন্ততি। এভাবে পৃথিবীতে পরিবার ও পারিবারিক ব্যবস্থার সূচনা হয়। পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তাদের দুই জন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ -সুরা আন নিসা : ১
বর্ণিত আয়াত থেকে বুঝে আসে যে, পারিবারিক বন্ধন থেকেই মানববংশ সম্প্রসারিত হয়েছে। যদি সবজাতি ও গোত্রের লোকেরা বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তবে সে পরিবার সমাজে সর্বোত্তম আদর্শ পরিবার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। যেখানে বইতে থাকে শান্তির ফল্গুধারা। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের বিচরণ হবে সুখকর ও আনন্দময়।
পরিবারের সদস্যরা যখন আল্লাহর দেওয়া দায়িত্বানুভূতি সম্পর্কে সজাগ থাকবে। স্ত্রী তার অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে লাভ করবে। স্বামী যখন স্ত্রীর নিকট তার অধিকার পাবে, সন্তান বাবা-মায়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য ও তাদের অধিকার লাভ করবে, আত্মীয়-স্বজন যখন পরস্পরের যথাযথ সম্মান মর্যাদা পাবে, তখন কোনো স্ত্রী আর তার অধিকারের দাবিতে প্রকাশ্য জনপথে আন্দোলনে বের হবে না, কোনো স্বামী ভালোবাসা ও সুন্দর জীবন-যাপনে অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হবে না, কোনো সন্তানই বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করবে না এবং আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কের দৃঢ়তায় আল্লাহর রহমত, বরকত ও অনুগ্রহ বর্ষিত হতে থাকবে। শুধু তাই নয়- ইসলাম নির্দেশিত পারিবারিক জীবন হলো- আল্লাহর মহা অনুগ্রহ।
মানুষ আল্লাহপ্রদত্ত পারিবারিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হলে সমাজ থেকে মহামারির আকার ধারণকারী পরকীয়া, মাদকাসক্তি, ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, অবৈধ ভালোবাসায় ব্যর্থদের আত্মহত্যাসহ সবপ্রকার অপরাধ প্রবণতা এবং জীবনের শেষ সময়ে বৃদ্ধাশ্রমের মতো দুঃখী জীবন-যাপন চিরতরে নির্মূল হবে।
তাই একটি সুন্দর ও আদর্শ পরিবার গঠনের লক্ষ্যে আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনাসমূহ মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানের অপরিহার্য দাবি।
আদর্শ ও উত্তম পরিবার গঠনে পরিবারের দায়িত্বশীলদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আর প্রচণ্ড অস্থির একটা পৃথিবীতে বাস করছি আমরা। আর এই অস্থির সময়ে সবচেয়ে অবহেলিত, উপেক্ষিত একটা টার্ম হচ্ছে- পরিবার। পরিবারগুলো এখন যখন তখন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
মনে রাখতে হবে, পরিবার হচ্ছে- সমাজ কাঠামোর মূল ভিত্তি, সুখী পরিবার একটি সুখী সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত। আর একটি সুন্দর পরিবার গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে- পরিবারকে ইসলামের আদলে গড়ে তোলা।