সমাজে যখন নৈতিক অবক্ষয় ঘটে, তখন মানুষের পরস্পরের মধ্যে মায়া-মমতা, সহমর্মিতা, সৌভাতৃত্ববোধ কমে যায়। হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, কুটনা-কুটনি এসব প্রবল রূপ ধারণ করে। সমাজের সদস্যরা একে অন্যের ভালো দেখতে পারে না। সুযোগ পেলেই একে অন্যকে ল্যাং মারতে চায়। কেউ বেপথু হলে অন্যরা তার জন্য কোনো দরদ অনুভব করে না। তাকে সুপথে আনার চেষ্টা চালানোর কোনো তাগিদ কাজ করে না। যে যার মতো স্রেফ সমালোচনা করেই দায় সারে।
অনেকেই আবার নিছক অভ্যাসবশে কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে কারো কোনো দোষ খুঁজে পেলে তা ফলাও করে প্রচার করে বেড়ায়। উদ্দেশ্য যতটা না অপকর্মের প্রতিবাদ করা, তার চেয়েও বেশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দুর্নাম রটানো এবং তাকে সমাজের কাছে হেয়প্রতিপন্ন করা।
সমাজে কারো কোনো দোষ পাওয়া গেলে, বিশেষ করে তা যদি একটু দৃষ্টিকটু ও সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হয় তাহলে এটা নিয়ে দশ কান করা আর রসিয়ে রসিয়ে একে-ওকে বলে বেড়ানোর বেশ চল আছে। সামাজিক এসব নিন্দা-মন্দের অবশ্য একটা ভালো সোস্যাল ইমপ্যাক্ট আছে। মানুষ সতর্ক হয়, সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে এ ধরনের কাজ এড়িয়ে চলে। তবে এসবই সমাজের নিরীহ গোছের ছা-পোষা মানুষের জন্য। জাঁদরেল পালোয়ান কিসিমের প্রভাবশালী লোকজন প্রকাশ্যে অপকর্ম করে বেড়ায়। এতে তাদের কোনো লাজলজ্জা কাজ করে না। বরং এটাকে তারা নিজেদের অহংকার বলে বিবেচনা করেন, বুক ফুলিয়ে বলে বেড়ান। আপনি দেখবেন, সোসাইটি তাদের ব্যাপারে আড়ালে-আবডালে ফিসফাস করলেও প্রকাশ্যে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে।
মনুষ্য সমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাদের জীবনাচারে আলেম-উলামা, পীর-দরবেশদের বিরাট প্রভাব রয়েছে। আপনি আলেম-উলামাদের সঙ্গে উঠা-বসা করলে বুঝে থাকবেন, ইসলাম কিছু ব্যতিক্রমী সিচুয়েশন বাদে কারো নিন্দামন্দ করে বেড়ানোকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে। এর কারণ এই যে, এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো মহৎ উদ্দেশ্য কাজ করে না, সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক সৌহার্দে চিড় ধরে, সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সামাজিকভাবে অনেকটা নিজের অগোচরেই হেয় হন।
আপনি তাবলিগ জামাতের লোকজনের সাহচর্যে এলে দেখবেন, তারা যে কয়টি বিষয়ের ওপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেন, তার একটি হলো- অন্যদের সম্মান করা।
ইদানীংকালে সমাজে একদিকে কিছু দুর্বৃত্তের দুরাচার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে এসবের প্রতিক্রিয়ায় সমাজের পরিমিতিবোধেও যেন বিশেষ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সমাজে দুষ্কর্মের ব্যাপকতায় মানুষের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি, যা তাদের অসহিষ্ণু করে তুলেছে। প্রায়ই দেশের কোনো না কোনো জায়গা থেকে রোমহর্ষক সব অপরাধকাণ্ডের খবর আসছে, যা মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে আরো ঘনীভূত করছে। দেশে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি সোস্যাল মিডিয়ার আগমন মানুষকে তাদের ধূমায়িত রোষ সহজে প্রকাশ করার বিশেষ সুযোগ এনে দিয়েছে। ফলে অনেক সময় দেখে থাকবেন, অনেকেই সংঘটিত ঘটনার গভীরে না গিয়েই হুটহাট মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।
এখানেই উদ্বেগের বিষয়। সমাজে আমরা সবাই পারস্পরিক মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ। এখানে কেউ অন্যায় কিছু করলে তাকে অবশ্যই আমরা ধরব, তিনি যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে থাকেন প্রয়োজনে তাকে শাস্তির আওতায়ও আনব। এজন্য শাস্তি ছাড়াও নিন্দা-মন্দেরও ভাগীদার তিনি অবশ্যই হবেন।
তবে সমালোচনা যেন কুৎসা রটনায় পর্যবসিত না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার। মনে রাখা চাই, সমাজের দায়িত্ব বিপথগামী সদস্যদের সুপথে আনা, তাদের প্রতি কোনো রকম বিদ্বেষ পোষণ কিংবা তাদের সম্মানহানি হতে পারে এমন কিছু করে বেড়ানো নয়।