কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার সঙ্গেই রয়েছে।’ -সূরা কাফ: ১৮
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মানুষের প্রত্যেকটি কথা লিপিবদ্ধ করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতা তা রেকর্ড করে নেয়। তাতে কোনো গোনাহ থাকুক বা না থাকুক।
আর হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে সতর্ক করে বলেছেন, মুখের কথা খুবই বিপদজনক। এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা অনেক সময় এমন কথা বলে যাতে সে গুরুত্ব দেয় না অথচ সে কথা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে। ফলে আল্লাহতায়ালা এর দ্বারা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। পক্ষান্তরে, বান্দা অনেক সময় এমন কথাও বলে যাতে সে গুরুত্ব দেয় না অথচ সে কথা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে। ফলে সে কথাই তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে।’ -সহিহ বোখারি: ৪৮৫
কাজেই অত্যন্ত হিসাব করে, জেনে-বুঝে কথা বলতে হবে। মুখ আছে বলেই সব কথা বলা যাবে না। সর্বদা চেষ্টা করতে হবে উত্তম ও কল্যাণকর কথা বলার। যদি উত্তম কথা বলার উদ্দেশ্য বজায় রাখা সম্ভব না হয়, তবে চুপ থাকা ভালো এবং চুপ থাকাটাও একটি উত্তম কাজ। এ বিষয়ে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে, নয়তো চুপ থাকে। -সহিহ বোখারি: ৪৮২
এভাবে হাদিসে নবী করিম (সা.) কথাবার্তায় সত্যবাদী হওয়ার এবং মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যা বলতে নিষেধ করা হয়েছে হাদিসে। হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই সত্য কথা বলবে। কারণ সত্য সদ্গুণের দিকে এবং সদ্গুণ জান্নাতের পথে চালিত করে। যে সর্বদা সত্য কথা বলে এবং সত্যকে গুরুত্ব দেয়, আল্লাহর কাছে তার নাম সত্যবাদীদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। মিথ্যা থেকে দূরে থাকো। কারণ মিথ্যা পাপের দিকে এবং পাপ জাহান্নামের আগুনের দিকে চালিত করে। যে অনবরত মিথ্যা বলে এবং মিথ্যা বলা ইচ্ছা রাখে, আল্লাহর নিকট তার নাম মিথ্যাবাদীদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়।’ –সহিহ মুসলিম: ৬৩০৯
হাদিসে কথাবার্তার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধাচরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, আল্লাহ অবাধ্য মন্দভাষীকে ঘৃণা করেন। ইসলামে জীবিত কোনো মানুষকে গালিগালাজ করা যেমন নিষিদ্ধ, মৃত ব্যক্তিকে গালিগালাজ করাও তেমনিভাবে নিষিদ্ধ।
কথা বলার সময় পরচর্চা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। তদ্রূপ লোকজনের মধ্যে এমন তথ্য না ছড়ানো যা তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার সৃষ্টি করে। এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গুজব ছড়ায় সে কখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’
জেনে-শুনে নিশ্চিত না হয়ে শুধু শোনা কথা নিয়ে মানুষের সঙ্গে আলাপ করা যাবে না। কারণ আপনি এমন কিছু শুনতে পারেন যা সত্যও হতে পারে আবার মিথ্যা কিংবা সন্দেহজনক। তাই যা শুনবেন তা প্রচার করলে আপনি পাপের অংশীদার হবেন। বিশুদ্ধ এক হাদিসে রাসূল (সা.) এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন, ‘একজন মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য একটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তা প্রচার করে বেড়ায়।’ -সহিহ মুসলিম: ৮
ইসলাম আদেশ দিয়েছে, নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিসীমার মধ্যে থেকে কথা বলতে। যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে মতপ্রকাশ ইসলাম নিষিদ্ধ কাজ। সেই সঙ্গে কথায় কথায় কসম খাওয়াও, অন্যকে ছোটো করা এবং অন্যের ওপর জয়লাভ করার উদ্দেশ্যে অনর্থক তর্কে লিপ্ত হওয়া ইসলামে নিষেধ। অকারণে তর্কে লিপ্ত হওয়া বিপথগামীতার লক্ষণ। এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সঠিক হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বিনা কারণে তর্ক করা বন্ধ করে আমি জান্নাতে তার জন্য একটি ঘরের নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’ -সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৮২
ইসলাম মনে করে, আপনার কথা হবে স্পষ্ট, সহজবোধ্য, দুর্বোধ্য শব্দমুক্ত। প্রয়োজন না হলে বাগ্মিতা পরিহার করুন এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কিছু বলা থেকে বিরত থাকুন। কথা শান্তভাবে, পরিষ্কার করে সর্ব সাধারণের কাছে বোধগম্য হয় এভাবে বলুন। কথাবার্তায় আন্তরিক হোন, অযথা কৌতুক করবেন না, অন্যের কথায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন না, কেউ কিছু বলতে চাইলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তাকে তার কথা শেষ করতে দিন। তার কথা শোনার পর যদি আপনার পক্ষ থেকে ভালো এবং প্রকৃত অর্থে প্রয়োজনীয় কিছু বলার থাকে তবে বলুন। শুধু শুধ বলতে চাওয়ার স্বার্থে কথা বলবেন না।
কথা বলুন আর তর্কই করুন- তা করতে হবে উত্তম পন্থায়। এতে করে যেন কারও ক্ষতি না হয়, মানসিকভাবে কেউ যেন আঘাত না পায়, কাউকে খাটো করা না হয়, তারও প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ প্রকাশ না পায়। এটাই ইসলামের নির্দেশ। দুনিয়ায় প্রেরিত সব নবী-রাসূলদের মাধ্যমে মানুষকে সুন্দরভাবে কথা বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কোনো অবস্থাতেই অন্যের কথাবার্তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করবেন না। মানুষের সামনে নিজের প্রশংসা করবেন না, নিজেই নিজেকে বাহবা দেবেন না। কারণ এমন উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তোমরা নিজেদের সাফাই গেয়ো না। তিনিই ভালো জানেন মুত্তাকি কে। -সূরা আন নাজম: ৩২