মৃত্যুবরণ করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। পরকালে শান্তিময় জীবন লাভ করতে চাইলে দুনিয়ায় মানুষকে ভালো আমল করে যেতে হয়। আমাদের সমাজের লোকেরা তাদের মৃত বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের জন্য বিভিন্ন রকমের আমল করে থাকে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগ সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে এ ক্ষেত্রে ভুল হয়। তাই আমাদের জেনে রাখা উচিত, কোন কোন আমল দিয়ে মৃত পিতা-মাতা ও আত্মীয়ের উপকার হয়।
হাদিসে বলা হয়েছে, মানুষ মৃত্যুর পর তার আমলনামায় দুই ধরনের আমল অব্যাহত থাকে। ক. মৃতের এমন আমল, যা তার জন্য সদকায়ে জারিয়া হয়; খ. এমন আমল যা মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতরা করে থাকে। যেমন মৃতদের জন্য জীবিতদের দোয়া, তাদের জন্য দান-সদকা করা, তাদের জন্য নফল হজ ও উমরা পালন করা।
সদকায়ে জারিয়া কী?
মানুষ মৃত্যুর পর জীবিত অবস্থায় তার কৃত আমলের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার সব আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের দরজা বন্ধ হয় না। ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. যদি কেউ এমন সন্তান রেখে যায়, যে সন্তান মা-বাবার জন্য দোয়া করবে ও ৩. এমন দ্বীনি শিক্ষা রেখে যায়, যা দিয়ে মানুষ উপকৃত হতে থাকে। -সহিহ মুসলিম
যেমন- মসজিদ, মাদরাসা বা কোনো দ্বীনি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে যাওয়া। অথবা জনকল্যাণমূলক কোনো কাজ করে যাওয়া, যার উপকার মানুষ তার মৃত্যুর পরও ভোগ করতে পারে অথবা এমন সন্তান তৈরি করে যাওয়া, যারা মৃত্যুর পরও তাদের বাবা-মা, আত্মীয়ের জন্য দোয়া করতে থাকে। কিংবা সে নেক আমল করতে থাকে, যার সওয়াব মৃত ব্যক্তি পেতে থাকবে। অথবা এমন ছাত্র তৈরি করে যাওয়া, যারা শিক্ষাবিস্তারে রত থাকে, এতে শিক্ষক তার সওয়াব পেতে থাকে। কিংবা এমন কোনো দ্বীনি কিতাবাদি রচনা করে যাওয়া, যা পড়ে মানুষ উপকৃত হতে থাকে।
মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের করা আমলের বর্ণনা
দ্বিতীয় প্রকার এমন আমল, যা মৃত ব্যক্তি নিজে করে যায়নি। কিন্তু তার পরও সে ওই আমলের সওয়াব পায়। এমন কিছু আমল হলো-
মাগফিরাতের দোয়া করা
কোরআন-হাদিসের একাধিক জায়গায় মা-বাবার সঙ্গে সব মুমিনের জন্য ও দোয়া করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকেও মৃতদের জন্য দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হাদিস আছে, হজরত উসমান বিন আফ্ফান (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর তার কবরের পাশে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, তোমরা তোমাদের ভাইদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করো এবং তার জন্য ঈমানের ওপর অবিচল ও দৃঢ় থাকার দোয়া কামনা করো। কেননা এখনই তাকে প্রশ্ন করা হবে।
মৃতের জন্য যে জানাজার নামাজ পড়া হয়, সেটি তার জন্য দোয়ার উদ্দেশ্যেই পড়া হয়। তা ছাড়া রাসূল (সা.) একাধিক হাদিসে কবর জিয়ারত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এসব কিছু প্রমাণ করে, মৃতের জন্য জীবিতদের উদ্দেশ্যে করা দোয়া ও ইস্তিগফার তার কাছে পৌঁছে এবং এর মাধ্যমে তিনি উপকৃত হন। অন্যথায় তার জন্য জানাজার নামাজ পড়া তার কবর জিয়ারত করার কোনো অর্থ থাকে না।
মৃতের জন্য সাধারণ দান-সদকা করা
হাদিসে আছে, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, জনৈক সাহাবি রাসূল (সা.) কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার মা হঠাৎ মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি কোনো অসিয়ত করে যেতে পারেননি। আমার ধারণা, তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন, তাহলে দান-সদকা করতেন। আমি তার পক্ষ থেকে দান-সদকা করলে কি তিনি এর সওয়াব পাবেন? নবী করিম (সা.) বলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম
এই হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয়, মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কেউ যদি দান-সদকা করে তাহলে সে তার সওয়াব পাবেন এবং এর মাধ্যমে তিনি উপকৃত হবেন।
মৃতের পক্ষে হজ আদায়
মৃতের পক্ষ থেকে হজ আদায় করা যেতে পারে। যদি মৃতের পক্ষ থেকে হজ অথবা উমরা আদায় করা হয়, তাহলে তার সওয়াব অবশ্যই মৃত ব্যক্তির কাছে যাবে, এর মাধ্যমে সে উপকৃত হবে।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর দরবারে এসে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার বোন হজের মান্নত করেছিলেন, কিন্তু তিনি হজ সম্পাদন করার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করতে পারি? হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমার বোনের ওপর যদি ঋণ থাকত তবে কি তুমি আদায় করতে না? সে বলল, অবশ্যই আদায় করতাম। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তা হলে তুমি তোমার বোনের পক্ষ থেকে হজ আদায় করো। কেননা আল্লাহর দাবি আদায় করার অধিক উপযোগী। -সহিহ বোখারি: ৮/১৪২
এ হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, হজ এমন একটি ইবাদত। যা একে অন্যের পক্ষ থেকে আদায় করতে পারে এবং এর সওয়াব তার কাছে পৌঁছে।
এ ছাড়া মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি করা। এ কোরবানির জন্য মৃত ব্যক্তি সওয়াব পেয়ে থাকেন। মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি করা জায়েজ। সুতরাং কেউ যদি নিজের কোরবানির সওয়াবে তার বাবা-মা, আত্মীয় ও মৃত ব্যক্তির নিয়ত করে নেয়, তাহলে তার সওয়াব তারা (মৃতরা) পেয়ে যাবেন। মৃতের পক্ষ থেকে রোজা রাখলেও সে সওয়াব পেয়ে থাকেন।
ওপরের আমলগুলো ছাড়া মৃত ব্যক্তির নামে চল্লিশা করা, মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা, কবরে ফুল দেওয়া, নিবরতা পালন করাকে ইসলাম সমর্থন করে না। আমাদের দেশে অনেক স্থানে মৃতের জন্য টাকার বিনিময়ে কোরআন খতম থেকে শুরু করে বিভিন্ন খতম দেওয়া হয়। এগুলোও ইসলাম সমর্থন করে না। এমন কাজ ইসলামে নিষিদ্ধ ও পরিত্যাজ্য।