মুসলমানদের পবিত্রগ্রন্থ কোরআনে কারিম ও কোরআন শিক্ষার প্রাথমিক বই বোগদাদিয়া কায়দা মুদ্রণ ও সরবরাহের কার্যাদেশ প্রদানে অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের সিভিল অডিট অধিদপ্তরের এক নিরীক্ষা পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে ৯৬টি অডিট আপত্তি উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ১, ১৩ ও ১৪ নম্বর আপত্তিতে সর্বমোট ৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৮৫ হাজার ৫০৪ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি উঠে আসে।
অডিট আপত্তির ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গণশিক্ষা কেন্দ্রের জন্য পাঠ্যপুস্তক ও কোরআনে কারিম মুদ্রণে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে কার্যাদেশ ও বিল পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৩ কোটি ৩৩ লাখ ৯৭ হাজার ৯০৪ টাকা।
আরও পড়ুন: বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াই সাড়ে ৩ শ’লোক নিয়োগ
অডিটের বিবরণে বলা হয়েছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতাধীন গণশিক্ষা কেন্দ্রের জন্য পাঠ্যপুস্তক ও কোরআনে কারিম মুদ্রণে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে কার্যাদেশ ও বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ২০০৯-১৮ অর্থবছরের বিশেষ নিরীক্ষায় পাঠ্যপুস্তক ও কোরআনে কারিম মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের কার্যাদেশ, দরপত্র, ডিপিপি, বিল-ভাউচার ও অন্যান্য রেকর্ডপত্র যাচাইয়ে এ অসঙ্গতি দেখা যায়।
অডিট আপত্তিতে বলা হয়, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পটি একটি জিওবি প্রকল্প। ডিপিপিতে উল্লেখিত প্রাক্কলিত মূল্য হিসেবে প্রতিটি কোরআনে কারিমের মুদ্রণ ও বাঁধাই ব্যয় ১৯৫ টাকা ধরা আছে। সে হিসেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেসকে কোরআনে কারিম সরবরাহের জন্য ১৯৫ টাকা ধরে ক্রয় আদেশ দেওয়া হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেস ওটিএম পদ্ধতিতে ঠিকাদারের কাছ থেকে কম মূল্যে কোরআনে কারিম নিয়ে প্রকল্পে সরবরাহ করেন।
একইভাবে গণশিক্ষা কেন্দ্রের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে ডিপিপিতে নির্ধারিত মূল্য মোতাবেক সরবরাহের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেসকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেস কর্তৃক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কার্যাদেশ মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে পাঠ্যপুস্তকগুলো সরবরাহ নিয়ে গণশিক্ষা প্রকল্পে সরবরাহ করে।
এভাবে শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্প কর্তৃক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেসের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করিয়ে অব্যয়িত অর্থ প্রকল্প থেকে সরিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেসে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাই নিরীক্ষার সুপারিশে, অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
একইভাবে অডিটের ১৩ নম্বর আপত্তিতে বলা হয়েছে, কার্যাদেশে উল্লেখিত বিল পরিশোধ করা সত্ত্বেও কমসংখ্যক কোরআনে কারিম সরবরাহ নেওয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৯৪ লাখ ৩৭ হাজার ৬শ’ টাকা।
অডিটে বলা হয়েছে, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পের শিশুদের মাঝে পুরস্কার হিসেবে বিতরণের জন্য ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮০ কপি কোরআনে কারিমের বিল (১১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬শ’ টাকা) পরিশোধ করে ৫ লাখ কপি গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি ৯৯ হাজার ৬৮০ কপির মূল্য বাবদ ১ কোটি ৯৪ লাখ ৩৭ হাজার ৬শ’ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮০ কপি কোরআন সরবরাহের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রিন্টিং প্রেসকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রেস থেকে ৫ লাখ কপি কোরআন সরবরাহ করা হয়। বাকি ৯৯ হাজার ৬৮০ কপি কোরআন সরবরাহ করা হয়নি। অথচ ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮০ কপি কোরআন মুদ্রণের বিল বাবদ পুরো ১১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ টাকাই পরিশোধ করা হয়েছে।
বিষয়টি ধরা পড়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রিন্টিং প্রেসের স্টক রেজিস্ট্রারের কারণে। জানা গেছে কোরআন ছাপানো বাবদ অর্থ আত্মসাতের জন্য নানামুখী চাতুর্যের আশ্রয় নেওয়া হয়। ২ যুগ ধরে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পের মেধাবি শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার হিসেবে স্কুলব্যাগ, ছাতা অথবা অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ দেয়া হতো। এ পুরস্কারের অর্থ প্রত্যেক জেলায় পাঠিয়ে দেয়া হতো। জেলা পর্যায় থেকে এসব কিনে শিশুদের দেওয়া হতো। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হঠাৎ করে ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল জেলায় টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন। তিনি প্রধান কার্যালয় থেকে পুরস্কার হিসেবে কোরআন শরিফ প্রদান করবেন বলে জানান। এরপর তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রিন্টিং প্রেসে ম্যানেজার হিসেবে তার এক নিকটাত্মীয়কে বদলি করে নিয়ে আসেন।
প্রথমে মহাপরিচালক কোরআন ছাপানোর জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রিন্টিং প্রেসকে কার্যাদেশ দেন। এর পর প্রকল্প দলিলে পুরস্কার হিসেবে রাখা ১১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৭ হাজা ৬শ’ টাকা প্রেসে স্থানান্তর করেন। অন্যদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রিন্টিং প্রেস কোরআন শরিফ ছাপানোর উদ্যোগ নিলে ডিজি তা বন্ধ করে দেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেসের পরিবর্তে বাইরের প্রতিষ্ঠানে তা ছাপানোর জন্য প্রেসের পক্ষ থেকে টেন্ডার আহ্বান করান। টেন্ডারের মাধ্যমে কৌশলে তার বন্ধুর প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেন। ওই প্রতিষ্ঠানে ১ লাখ কপি কম ছাপানো হয় এবং প্রায় ২ কোটি টাকা এভাবে আত্মসাৎ করা হয়।
শুধু কোরআন ছাপানো নয় কোরআন শিক্ষার প্রাথমিক বই বোগদাদিয়া কায়দা ছাপিয়ে সরকারি কোষাগারের অর্ধকোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে ডিজির বিরুদ্ধে। অডিটের ১৪ নম্বর আপত্তিতে বলা হয়েছে, ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) উল্লেখিত পুস্তকের তালিকায় বোগদাদিয়া কায়দা মুদ্রণের উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও মুদ্রণ ব্যয় বাবদ ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
অডিট নিরীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ডিপিপিতে উল্লেখিত পুস্তকের বাইরে অন্যকোনো পুস্তক মুদ্রণের অবকাশ নেই। তাই দায়-দায়িত্ব নির্ধারণপূর্বক দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ আপত্তিকৃত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া প্রয়োজন।
২০০৯ সালে থেকে টানা ১০ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান দায়িত্ব পালন করে আসছেন সাবেক জেলা জজ সামীম মোহাম্মদ আফজাল। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে বিশেষ নিরীক্ষা চালানো হয়। নিরীক্ষায় ৯৬টি খাতে দুর্নীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে অডিট টিম। সেই ৯৬টি আপত্তির ৩টিতে পাওয়া গেছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ঘাপলা।