ইসলামিক ফাউন্ডেশনে দুর্নীতি

বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াই সাড়ে ৩ শ’লোক নিয়োগ

  • মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল, ছবি: বার্তা.কম

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল, ছবি: বার্তা.কম

পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি, নেওয়া হয়নি নিয়োগ পরীক্ষাও। অথচ রাজস্ব খাতে সাড়ে ৩ শ’ লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উপ-পরিচালক এবং সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাসহ অন্যান্য পদের কর্মকর্তা-কর্মচারী।

আরও পড়ুন: বাড়িকে মাদরাসা দেখিয়ে ইফা ডিজির অর্থ আত্মসাৎ 

বিজ্ঞাপন

আরও অবাক তথ্য হচ্ছে পদসমূহের বেশিরভাগই তখনও সৃজন হয়নি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে কাল্পনিক পদ সৃষ্টি করে ওইসব পদে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে সরকারি খাত থেকে। অদ্ভুত এ নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনে।

এ নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, জেলা কোটা, মহিলা কোটা কিংবা অন্য কোনো কোটা অনুসরণ করা হয়নি। প্রথমে তাদের দৈনিকভিত্তিতে নিয়োগ দেখানো হয়েছে। তার পর নিয়মিত করণের নামে সিলেকশন কমিটির সভা ডেকে কর্মপত্র তৈরি করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

অথচ ইসলামিক ফাউন্ডেশন চাকরিবিধিতে এ ধরনের দৈনিকভিত্তিক নিয়োগ কিংবা নিয়মিত করণের নামে চাকরি প্রদানের কোনো বিধান নেই। নিয়োগপ্রাপ্তদের বেতন দেওয়া হচ্ছে সরকারের রাজস্বখাত থেকে। ইতোমধ্যে তাদের বেতনভাতা বাবদ খরচ হয়েছে সাড়ে ১৮ কোটিরও বেশি টাকা। ভবিষ্যতে পেনশনসহ তাদের পেছনে সরকারের ব্যয় হবে আরও শত শত কোটি টাকা।

বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের সিভিল অডিট অধিদপ্তরের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। নিরীক্ষা পরিদর্শন প্রতিবেদনের ৯৬টি আপত্তির মধ্যে ৫৬ নম্বর আপত্তিতে অডিট দল উল্লেখ করেছে, ১৩৫ জনের নিয়োগের কারণে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে ১৪ কোটি ৮০ লাখ ৭২ হাজার ৪২৭ টাকা।

এ ছাড়াও উপ-পরিচালক পদমর্যাদায় মহিলা কো-অর্ডিনিটের, আইন উপদেষ্টা, সম্পাদক এবং সহকারী পরিচালক পদমর্যাদায় সহকারী সম্পাদকসহ প্রায় ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ কিংবা পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ সম্পন্ন। এতে সরকারের ১ কোটি ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯৭৭ টাকা ক্ষতি হয়েছে। অডিট প্রতিবেনের ৫২ ও ৭০ নম্বর আপত্তিতে এসব বিস্তারিত বলা হয়েছে।

দৈনিক ভিত্তিতে নিয়ম বর্হিভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২২৪ জনকে। এতে সরকারের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৫ লাখ ৪ হাজার টাকা। অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া এসব কর্মচারীকে নিয়মিতকরণের জন্য অত্যন্ত গোপন প্রক্রিয়া অব্যহত রেখেছে ইফা ডিজি।

এসব দু’নম্বরী নিয়োগের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের ঘনিষ্ঠ একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে ৪ জন বোর্ড সদস্য, সাবেক ২ পরিচালক, প্রশাসনে কর্মরত ১ জন পরিচালক,প্রশাসন বিভাগের সাবেক একজন কর্মকর্তা ও হিসাব বিভাগের ১ জন কর্মকর্তাসহ মহাপরিচালকের কয়েকজন নিকটাত্মীয় নাম উঠে এসেছে অডিট রিপোর্টে।

অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের কেউ কেউ নিয়োগের কয়েকদিনের মধ্যে নিজেও নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন বলে ফাউন্ডেশন সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু ডিজির ভয়ে তখন কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।

মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ সব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে এ নিরীক্ষা চালানো হয়। এতে প্রাথমিকভাবে ১৩২টি আপত্তিতে প্রায় ৯ শ’ কোটি টাকা নয়-ছয়ের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। পরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল প্রায় ৭৩ কোটি টাকা ফেরত দেন। এরপরও ৯৬টি খাতে দুর্নীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে অডিট টিম।

গত ২৪ নভেম্বর সিভিল অডিট অধিদপ্তর, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের প্রতিনিধিদের ত্রিপক্ষীয় এগ্রিড বৈঠক সম্পন্ন হয়। এতে ৯৬টি অনুচ্ছেদের আপত্তির কোনোটিই নিষ্পত্তি হয়নি। তাই খসড়া রিপোর্ট সামান্য পরিবর্তন-পরিমার্জন করে চূড়ান্ত করে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সাবেক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা সামীম মোহাম্মদ আফজাল নানা কারণে সমালোচিত। ক্ষমতার অপব্যবহার, বেআইনি কর্মকাণ্ড এবং দুর্নীতির কারণে সামীম মোহাম্মদ আফজালকে চলতি বছরের ১০ জুন ডিজি পদে নিয়োগের জন্য তার চুক্তি কেন বাতিল করা হবে না এবং কেন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে না তার ব্যাখ্যা চেয়ে শোকজ করেছিল ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন শুরু করে। তখন অচলাবস্থা কাটাতে তিনি ৩ দিনের ছুটি নেন। এর প্রেক্ষিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বোর্ড অব গভর্ণর ডিজির ক্ষমতা হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেয়।

বিতর্কের মধ্যেই সামীম মোহাম্মদ আফজালের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে সামীম আফজালের নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে।

২০০৯ সালে থেকে টানা ১০ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান দায়িত্ব পালন করে আসছেন সাবেক এই জেলা জজ।

ডিজির পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও ছিলেন সামীম আফজাল। সেখান থেকেও তাকে সরিয়ে দেওয়া অজানা কারণে।

দুর্নীতি অনিয়মসহ নানা রকম অপকর্মের কারণে সমালোচিত ইফা ডিজি সামীম আফজালের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হবে ৩১ ডিসেম্বর। নতুন করে নিয়োগ পেতে জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।