কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের জন্য আপৎকালীন তহবিল গঠন আবশ্যক শিরোনামে একটি বিশেষ নিবন্ধ সোমবার (৩০ মার্চ) বার্তা২৪.কম প্রকাশ করে। নিবন্ধটি পাঠক মহলে বিশেষ করে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কওমি মাদরাসায় শিক্ষিত আলেম-উলামারা সমাজের ধর্মীয় বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন অনেকটা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। বিভিন্ন কারণে তারা শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতিসহ নানা বিষয়ে পিছিয়ে। সঙ্গত কারণেই তারা অর্থনৈতিক বিষয় তথা আর্থসামজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পিছিয়ে। আসলে পিছিয়ে না বলে, বলা চলে তারা চরমভাবে অবহেলিত, উপেক্ষিত। অথচ সমাজের সামগ্রিক উন্নতি, সমৃদ্ধির জন্য এ বিষয়গুলোর সমন্বিত উন্নয়ন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। না হলে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার, সচেতন জনগণ এবং এ সংশ্লিষ্ট সবার।
প্রকাশিত নিবন্ধে প্রস্তাব করা হয়েছে, ‘কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের জন্য আপৎকালীন তহবিল গঠনে’ কওমি মাদরাসাগুলো দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান বোর্ডগুলোকে। কওমি মাদারাসাগুলোর নানা বিষয়ে পরিচালনা ও দেখাশোনার জন্য আঞ্চলিক, বিভাগীয় ও সমন্বিত অনেকগুলো বোর্ড থাকলেও ছয়টি বোর্ডকে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে, এবং এই ছয় বোর্ডের সমন্বয়ে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ গঠন করা হয়েছে। ওই ছয় বোর্ড হলো- বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ বেফাক (ঢাকা), বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গা (গোপালগঞ্জ), আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ (চট্টগ্রাম), আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তালিম বাংলাদেশ (সিলেট), তানযীমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ (উত্তরবঙ্গ) ও জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ (ঢাকা)।
এই ছয় বোর্ডের মধ্যে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ বেফাক দেশের কওমি মাদরাসাগুলোর সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন। সে হিসেবে পূর্বতন নিবন্ধকার হয়তো দাবি-দাওয়া পেশের ক্ষেত্রে বেফাককে সম্বোধন করেছেন, তাদের এগিয়ে আসতে বলেছেন। বেফাকভূক্ত মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে সঙ্গত কারণে আমিও এই নিবন্ধে বেফাককে সম্বোধন করবো। তবে অন্য বোর্ডগুলোরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এ ক্ষেত্রে।
আমরা জানি, বেফাক তার অধীনে নিবন্ধিত কওমি মাদরাসার সকল শ্রেণি ও স্তরের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ২০ টাকা করে বার্ষিক ফি নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বেফাকভূক্ত মাদরাসার সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। এ সব মাদরাসার শিক্ষার্থী সংখ্যা আনুমানিক ১০ লাখের মতো। সে হিসেবে বার্ষিক ফি’ দাঁড়ায় প্রায় ২ কোটি টাকা। ১৯৭৮ সালে বেফাক প্রতিষ্ঠা হয়। শুরুর দিক থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেফাকের নিজস্ব অফিস, অবকাঠামো, ব্যবস্থাপনা, জনবল ও আয়ের উৎস তেমন ছিল না। তখন শিক্ষার্থীদের এ চাঁদার টাকাই ছিল বেফাকের চালিকা শক্তি। কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে। বেফাকের নিজস্ব জমি হয়েছে, রয়েছে দক্ষ জনবল, আয়ের প্রচুর খাত। সুতরাং এখন বেফাকের জন্য শিক্ষার্থীদের এ টাকার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই, ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানো ছাড়া। সুতরাং এটা নিশ্চিত বলা চলে, শিক্ষার্থীদের দেওয়া এই টাকাকে ভিত্তি করে অনায়েসে সুন্দরভাবে দাঁড়াতে পারে ‘কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের আপৎকালীন তহবিল।’ এ জন্য দরকার শুধু আন্তরিক উদ্যোগ আর সদিচ্ছা।
এ ধরণের একটি তহবিল গঠন হলে আপৎকালীন প্রণোদনা ছাড়াও কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তার কল্যাণে অনেক কিছু করা সম্ভব হবে। যেমন- নদী ভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডসহ নানা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষকদের বাড়ি নির্মাণ, ব্যয়বহুল রোগে আক্রান্ত শিক্ষকদের চিকিৎসা সহায়তা। উপরন্তু যে সব ত্যাগী শিক্ষক শিক্ষার্থীদের তরবিয়তের মহান ব্রত নিয়ে মাদরাসার আবাসিক দায়িত্ব গ্রহণ করে ২৪ ঘণ্টা মাদরাসায় পড়ে থাকেন, ইচ্ছা থাকলেও উপার্জনের অন্যকোনো সহায়ক পথ গ্রহণ করতে পারেন না। এ ধরণের শিক্ষকদের সাংসারিক প্রয়োজনে করজে হাসানাহ প্রদান।
তবে এটা স্বীকার করি, এ ধরণের একটি তহবিল গঠন ও পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা হবে মাদরাসাগুলোর শিক্ষক নিয়োগ ও অব্যাহতি প্রদানের বিদ্যমান পদ্ধতি। বর্তমানে অধিকাংশ কওমি মাদরাসা শিক্ষক নিয়োগ হয় মৌখিক। কোনো নিয়োগপত্র প্রদান করা হয় না। তেমনি অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও স্বীকৃত কোনো স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম মেনে চলা হয় না। ফোনে, লোক মারফত ও মুখে শুধু জানিয়ে দেওয়া হয়- মাদরাসায় আপনার আর প্রয়োজন নেই। কেন অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে তা জানানো হয় না, তার ভুল-ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয় না। কোনো শোকজ নোটিশ দেওয়া হয় না। পক্ষান্তরে শিক্ষকরাও যার যখন মনে চায়- প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যান। শিক্ষাবর্ষ শেষ করার কিংবা চাকরি ছাড়া ১-২ মাস আগে মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে জানানোর কোনো গরজ তারা অনুভব করেন না। যদিও এ সবের পেছনে প্রত্যেক পক্ষেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের বিভিন্ন বক্তব্য আছে। কিন্তু সার্বিকভাবে চিত্রটি সুখকর নয়, সুন্দর নয়। এর ফলে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
আরও পড়ুন: দুই লক্ষাধিক কওমি শিক্ষকের কথা ভাববার কেউ নেই!
কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির কারণে হাইয়াতুল উলইয়ার অন্তর্ভুক্ত ৬টি বোর্ড এখন একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। মাদরাসাগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা কারিকুলাম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে পরিচালনা পদ্ধতিসহ প্রয়োজনীয় বিষয়ে শৃঙ্খলা আনতে তারা তাদের আইনগত শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। এ বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাবনা হলো-
ক. হাইয়ার অধীনে সকল শিক্ষককে নিবন্ধনভূক্ত করে নিবন্ধন নম্বর প্রদান করা।
খ. নিবন্ধন নম্বরবিহীন কোনো ব্যক্তিকে হাইয়ার অধীন ৬ বোর্ডের অধিভূক্ত কোনো মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান না করা।
গ. নতুন যারা শিক্ষকতায় আসতে ইচ্ছুক, তারা প্রথমে হাইয়াতে আবেদন করে নিবন্ধনভূক্ত হবে।
ঘ. কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকাকে চাকরি থেকে অব্যহতি প্রদান করতে হলে কমপক্ষে ৩ মাস আগে তার ত্রুটি উল্লেখপূর্বক নোটিশ প্রদান করা।
ঙ. নোটিশে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকার আপত্তি থাকলে নোটিশ প্রাপ্তির ১ মাসের মধ্যে হাইয়াকে জানানো। হাইয়া অথবা বোর্ড বিষয়টি দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি করবে। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষিকা নির্দোষ প্রমাণিত হলে প্রতিষ্ঠানকে সংযত হওয়ার নোটিশ দেবে এবং তা ওয়েবসাইটে প্রচার করবে। আর যদি শিক্ষক-শিক্ষিকা দোষী প্রমাণিত হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানের অব্যাহিত প্রদান মঞ্জুর করবে। শিক্ষক-শিক্ষিকার দোষ লঘু হলে তাকে সংশোধনের নোটিশ দেবে। আর দোষ গুরুতর হলে যেমন- চূড়ান্ত নৈতিক স্খলন, অর্থ আত্মসাত ইত্যাদি; তাহলে তার নিবন্ধন বাতিল করা হবে।
চ. কোনো শিক্ষক অব্যহতির আবেদন করলে তাতে প্রতিষ্ঠানের আপত্তি থাকলে আবেদন প্রাপ্তির ৭ দিনের মধ্যে হাইয়াকে জানাবে। হাইয়া বা বোর্ড দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করবে। অগ্রহণযোগ্য কারণে শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি সময়ে অব্যাহতি গ্রহণে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার নিবন্ধন বাতিল করা হবে। অব্যহতির আবেদনের গ্রহণযোগ্য কারণ থাকলে হাইয়া বা বোর্ড উক্ত আবেদন মঞ্জুর করতে প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেবে।
এভাবে শিক্ষক নিয়োগ ও অব্যাহতিতে একটা শৃঙ্খলা আসলে আপৎকালীন তহবিলের দ্বারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ অনেকটাই সহজ হবে।
মুফতি মাহফূযুল হক: কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও কলাম লেখক