ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার প্রতিষ্ঠিত বিষয়

, ইসলাম

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 07:29:35

ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষাগত সংখ্যালঘুর মানবাধিকারের দাবিতে সোচ্চার বিশ্ব সম্প্রদায় আইনগত ও সামরিক-বেসামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেও বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানবতার আহাজারি থামাতে পারছে না। বরং ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকার পরেও মুসলিমরাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। ‘ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার’ সম্পর্কে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা: পর্ব- ৭

অমুসলমান ও সংখ্যালঘুদের প্রতি ইসলামের সমানাধিকার, সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ, যা ধর্মীয় নৈতিকতা ও আদর্শিক বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে আইনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় সকল সময়ই প্রতিপালিত হয়েছে, তা আজকেও প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্র আর মুসলমান সম্মিলিতভাবে বিশ্বাস করেন এবং স্বীকৃতি প্রদান করেন। ১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট মিসরের রাজধানী কায়রোয় অনুষ্ঠিত ৬ দিনব্যাপী ঊনিশতম ইসলামিক কনফারেন্সে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়ে ২৫টি ধারা এবং ৩৭টি ঊপধারাবিশিষ্ট ‘ইসলামে মানবাধিকার সম্পর্কিত ঘোষণা’র কয়েকটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হলে ইসলামের সাম্যভিত্তিক সমঅধিকারের প্রসঙ্গটি সুস্পষ্ট হবে বলে বিশ্বাস করি, যেখানে মুসলমান-অমুসলমানের ওপর বিধানসমূহ সমভাবে প্রযোজ্য-

১. সমগ্র মানব জাতি এক পরিবার।
২. জাতি, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, নারী, পুরুষ, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক মতবাদ, সামাজিক অবস্থান বা অন্য কোনো বিবেচনায় মৌলিক মানবিক মর্যাদা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিক থেকে সকল মানুষ সমান।
৩. প্রতিটি মানুষই আল্লাহর সৃষ্ট জীব।
৪. সে ব্যক্তিকে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, যে আল্লাহর সৃষ্টি জগতের কল্যাণে নিয়োজিত।
৫. শুধুমাত্র তাকওয়া এবং সৎকর্মের ভিত্তিতে একজন মানুষ অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে।
৬. জীবন হলো আল্লাহপ্রদত্ত এক নিয়ামত।
৭. প্রত্যেক ব্যক্তিরই জীবন-ধারণের নিশ্চয়তা বিধানের অধিকার ইসলামে স্বীকৃত।
৮. প্রত্যেক ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো- মানুষের জীবন-ধারনের অধিকারকে যে কোনো প্রকার অবমাননা থেকে রক্ষা করা।
৯. আইন-নির্দেশিত কোনো কারণ ও বিধান ছাড়া কাউকে হত্যা করা হারাম।
১০. এমন কোনো কাজ বা উপায় অবলম্বন করা নিষিদ্ধ, যা মানব জাতির ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

১১. স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কারও জীবন রক্ষা করা ইসলামী আইন নির্দেশিত একটি কর্তব্য। শারীরিক ক্ষতি বা নির্যাতন থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার জন্যই সুরক্ষিত; এ নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং আইন-নিদের্শিত কোনো কারণ ছাড়া এ অধিকার লঙ্ঘন করা নিষিদ্ধ।

১২. সামরিক অভিযান বা সশস্ত্র কোনো সংঘর্ষের সময় নির্দোষ ব্যক্তি, যেমন-বৃদ্ধ, নারী এবং শিশু হত্যা নিষিদ্ধ। আহত ও পীড়িত ব্যক্তির চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। যুদ্ধবন্দীদের অধিকার রয়েছে অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় পাওয়ার। মৃতদেহ বিকৃত করা অবৈধ। যুদ্ধবন্দী বিনিময় এবং যুদ্ধের ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বা পুর্নমিলনের ব্যবস্থা করে দেওয়া মানবিক কর্তব্য।

১৩. গাছপালা বিনাশ, শস্য ও প্রাণীর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি সাধন, প্রাণহানিকর শেল নিক্ষেপ, বোমা বিস্ফোরণ বা অন্য কোনো প্রকারে শত্রুপক্ষীয় বেসামরিক সাধারণ মানুষের ঘর-বাড়ি ও সহায়-সম্পত্তির ক্ষতি সাধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

১৪. প্রত্যেক ব্যক্তি, জীবিত বা মৃত সকল অবস্থায়, পবিত্রতা রক্ষার অধিকারী এবং আপনাপন সুনাম ও মর্যাদা রক্ষার অধিকারী। রাষ্ট্র বা সমাজ পরিত্যাক্ত ধন-সম্পত্তি ও সমাধি রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে।

১৫. সমাজের বুনিয়াদ হলো পরিবার এবং পরিবার গঠনের ভিত্তি হলো বৈবাহিক প্রথা। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া অধিকার আছে। গোত্র, বর্ণ বা জাতীয়তার কারণে উদ্ভূত কোনো প্রতিবন্ধকতার জন্য তাদেরকে এ অধিকার ভোগ করা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

১৬. সমাজ এবং রাষ্ট্র বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করার দায়িত্ব নেবে এবং বৈবাহিক প্রক্রিয়াকে সহজতর করে তুলবে। পরিবারের নিরাপত্তা বিধান এবং কল্যাণ সুনিশ্চিত করবে সমাজ ও রাষ্ট্র।

১৭. মর্যাদা এবং তা ভোগ করার অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের দিক থেকেও সকলের অধিকার সমান।
১৮. সন্তানের ভ্রুণ এবং সন্তানের মা, উভয়কে অবশ্যই নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে এবং তাদের যথাযথ পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে।
১৯. মা-বাবা অথবা উপযুক্ত দায়িত্বপূর্ণ অভিভাবকের অধিকার রয়েছে তাদের শিশুদের জন্য যে কোনো প্রকার শিক্ষাদানের পদ্ধতি বেছে নেওয়ার।

২০. প্রতিটি মানুষ বাধ্যবাধকতা ও অঙ্গকারের ভিত্তিতে তার বৈধ ক্ষমতা উপভোগের অধিকার রাখে।
২১. কোনো রকম বল প্রয়োগ বা জোরজবরদস্তি অথবা কারো দারিদ্র্য বা অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কাউকে ধর্মান্তরিত করা যাবে না।
২২. প্রতিটি মানুষ স্বাধীনসত্তা হিসাবে জন্মগ্রহণ করে। কাউকে দাসত্বে আনা, অবমাননা করা, শোষণ করা বা তাকে হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার অধিকার কারো নেই।

২৩. আইনের সীমারেখার মধ্যে প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরা, স্বদেশের সীমার ভেতরে বা বাইরে নিজ বাসস্থান নির্বাচনের অধিকার রয়েছে। অধিকার রয়েছে নির্যাতনের শিকার হলে অন্য রাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় প্রার্থনার।

২৪. প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষের জন্য কাজ পাওয়ার ও করার সমানাধিকার রাষ্ট্র-সমাজ কর্তৃক নিশ্চিত করতে হবে।
২৫. বৈধ উপায়ে প্রাপ্ত সম্পদ ভোগের অধিকার সমকলের জন্য সমানভাবে রয়েছে।
২৬. প্রত্যেকের স্ব স্ব বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সাহিত্যকর্ম, শিল্পকর্ম বা প্রযুক্তিগত সৃজনশীলতার ফলাফল ভোগের অধিকার সবার রয়েছে এবং এ সব কর্ম থেকে উদ্ভূত নৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থসমূহ রক্ষার অধিকারও তাদের রয়েছে।

২৭. প্রত্যেকের পরিচ্ছন্ন পরিম-লে আত্মোন্নয়নের অনুকূল পরিবেশে বসবাসের অধিকার রয়েছে।
২৮. প্রত্যেকের সুচিকিৎসা ও সামাজিক সুবিধাদি ভোগ করার অধিকার রয়েছে।
২৯. রাষ্ট্র প্রতিটি ব্যক্তির শালীন, স্বচ্ছল জীবন-যাপনের অধিকারকে সুনিশ্চিত করবে, যা তার এবং তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তির খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান. শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদাসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয়তা পূরণে সক্ষম।
৩০. প্রত্যেকেরই নিরাপদে বসবাসের অধিকার রয়েছে। এই নিরাপত্তা যেমন তার নিজের, তেমনি তার সম্মান-সম্পত্তি, তার ওপর নির্ভরশীলদের এবং তার ধর্মের ব্যাপারেও প্রযোজ্য।

৩১. প্রত্যেকেরই জীবন-যাপন ও কাজ-কর্মে, নিজ বাড়িতে, নিজ পরিবারে, নিজ সম্পত্তির ব্যাপারে এবং আত্মীয়তা বা অন্য কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বজায় রেখে নিরুপদ্রবে থাকার অধিকার রয়েছে। কোনো ব্যক্তির ওপর গুপ্তচরবৃত্তি, তাকে কড়া নজরে বা পাহাড়ায় রাখা অথবা তার সুনাম ক্ষুণœ হতে পারে, এমন কোনো কাজ করা যাবে না। রাষ্ট্র তাকে অযৌক্তিক এবং স্বেচ্ছাচারমূলক যে কোনো রকম অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করবে।

৩২. প্রত্যেকের বসতবাটির নিরাপত্তা বিধান ও তাতে অবৈধ হস্তক্ষেপ না হতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং বাসিন্দাদের অনুমতি ছাড়া বা বেআইনীভাবে কারো বাসগৃহে প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং এর বাসিন্দাদেরকে জোরপূর্বক বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা, তাদের বাসস্থান বলপূর্বক দখল করে নেওয়া বা বাড়ি-ঘর নির্মূল করা যাবে না।
৩৩. শাসক ও শাসিত নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের চোখে সমান।
৩৪. ন্যায়বিচার প্রত্যেক ব্যক্তির প্রাপ্য।
৩৫. প্রত্যেকের দায় একান্তভাবে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত।

৩৬. আইন-সঙ্গত কোনো কারণ ছাড়া কাউকে যেন শাস্তি দেওয়া না হয়, তার ব্যবস্থা করা।
৩৭. নিরপেক্ষ বিচারে বা শুনানীর মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তিই নির্দোষ। এ নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়ায় বা মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে।

৩৮. বৈধ কারণ ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা, তার স্বাধীনতাকে খর্ব করা বা কেড়ে নেওয়া, তাকে নির্বাসিত করা বা কয়েদ করা অথবা তাকে শাস্তি দেওয়া অসঙ্গত। কাউকে কোনো প্রকার দৈহিক বা মানসিক নির্যাতন করা বা তার মানহানি করা ও তার প্রতি কোনো প্রকার নিষ্ঠুরতা বা তাকে কোনো রকম অমর্যাদা করা যাবে না। অথবা কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া বা তার স্বাস্থ্য বা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কোনো ডাক্তারি বা বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা পরীক্ষায় তাকে ব্যবহার করা যাবে না।

৩৯. যে কোনো প্রকারে অথবা যে কোনো উদ্দেশ্যে কাউকে জিম্মি করা সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ।
৪০. প্রত্যেকেরই স্বাধীনভাবে নিজস্ব মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকেরই সঠিক বিষয়ের পক্ষে কথা বলার বা সুপারিশ করার এবং যা কিছু ভালো, তা প্রচার ও প্রসারের অধিকার রয়েছে।
৪১. এমন কোনো মতবাদ, যা পরস্পরের মধ্যে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ায় বা বর্ণগত ও গোত্রীয় বিভেদ সৃষ্টি করে, তা অনুমোদিত নয়।
৪২. ক্ষমতা একটি আমানতস্বরূপ; এটাকে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ বা কাউকে বঞ্চিত করা, অপপ্রয়োগ করা, বিদ্বেষ দ্বারা পরিচালিত হয়ে কাউকে হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
৪৩. নিজ রাষ্ট্রের প্রশাসনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকের রয়েছে।

আরও পড়ুন: পর্ব-৬: প্রকৃত ইসলামী সমাজ সব ধর্মাবলম্বীর সমানাধিকারের রক্ষাকবচ

এ সম্পর্কিত আরও খবর