কওমি ও আলিয়া মাদরাসার পাশাপাশি ‘দারুল আরকাম’ নামে তৃতীয় একটি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলো ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
পরিকল্পনা ছিলো দারুল আরকাম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে শিক্ষার্থীদের ইবতেদায়ি (মাদরাসার প্রাথমিক পর্যায়) সমমানের সনদ দেওয়া হবে। এই সনদ নিয়ে যেকোনো শিক্ষার্থী আলিয়া মাদরাসায় নিম্নমাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিপ্রায়ে ২০১৮ সনে শুরু হয় দারুল আরকাম প্রকল্প। কিন্তু একটি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা দেখভাল করার মতো লোকবল, সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ছিলো না। যে কারণে শুরু থেকেই প্রকল্পটি নিয়ে নানা কথা চলছিলো। প্রকল্পটির ভবিষ্যত নিয়েও দেখা দিয়েছিলো নানা শঙ্কা ও উদ্বেগ। এসব অনিশ্চয়তা ও গুঞ্জনের মাঝেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকল্প থেকে দারুল আরকাম মাদরাসা বাদ পড়লো।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্প থেকে দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা বাদ দেওয়ায় সারাদেশে দুই লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিয়তার মুখে পড়লো।
সারাদেশে প্রত্যেক উপজেলায় দু’টি করে দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসার আলেম শিক্ষক-শিক্ষিকারা দীর্ঘ ৫ মাস যাবত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। লকডাউনের মাঝে ১ হাজার ১০টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক শিক্ষিকারা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। এরই মাঝে প্রকল্প বাদ দেওয়ায় তাদের জীবনের নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, তারা কারও কাছে হাতও পাততে পারছেন না। আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে তাদের ভাগ্যে বকেয়া বেতন-বোনাসও জুটছে না।
ইফা সূত্রে জানা গেছে, ১১ মে পরিকল্পনা কমিশন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রস্তাবিত পাঁচ বছর মেয়াদি সপ্তম পর্বে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পে ৩ হাজার ১২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তবে উল্লেখিত প্রকল্প থেকে দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসাকে বাদ রাখা হয়েছে। এতে ইফার দারুল আরকাম মাদরাসায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক শিক্ষিকাদের মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তবে শোনা যাচ্ছে, দারুল আরকামের জন্য পৃথকভাবে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হবে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তা বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিপ্রায়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে সারাদেশে দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত না নিয়ে মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা প্রকল্প থেকে দারুল আরকাম মাদরাসা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব মাদরাসাগুলো চলার জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। সারাদেশে এসব মাদরাসায় আরও তিন হাজার ত্রিশজন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আনিস মাহমুদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শেই মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্প থেকে ১ হাজার ১০টি দারুল আরকার ইবতেদায়ি মাদরাসা পৃথক করা হয়েছে। এসব মাদরাসার শিক্ষকদের পদগুলো স্থায়ী হবে। সরকারের বিধি অনুসরণ করে এসব মাদরাসাগুলো এমপিওভুক্তকরণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে বলেও ইফা মহাপরিচালক উল্লেখ করেন।
ইফা ডিজি আনিস মাহমুদ আরও বলেন, কোনো প্রজেক্ট তো আর সারাজীবন চলে না। দারুল আরকাম একটি অলটারনেটিভ শিক্ষা ব্যবস্থা। এটা শিশু ও গণশিক্ষার মতো নয়। দারুল আরকামের শিক্ষকরা ফুলটাইমের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত। এর সাথে স্থাপনা, শিক্ষার সনদসহ নানা বিষয় জড়িত। সুতরাং শিক্ষকদের কল্যাণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতসহ স্থায়ী রূপরেখা প্রণয়ন করে দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসার জন্য পৃথকভাবে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হবে।
কিন্তু দারুল আরকামের শিক্ষকরা বলছেন, এসব মাদরাসা বন্ধ হবে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে গিয়েছি তিনি আমাদের আশা দিয়েছেন। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ আশ্বাস দিয়েছেন। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসার কেউ বঞ্চিত হবে না। এখন কি কারণে দারুল আরকাম মাদরাসাকে প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে জানি না।
দারুল আরকামের শিক্ষকরা বকেয়া বেতন-বোনাস ঈদের আগেই পরিশোধ এবং মাদরাসাগুলো চালুর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
শিক্ষাবিদরা শুরু থেকেই নতুন এই মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছেন। তারা নতুন এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পেছনে রাজনীতি রয়েছে বলে সন্দেহ করেছিলেন। তাদের মতে, বিদ্যমান মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাগুলোর দিকেই আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে উন্নতি করা দরকার। সমন্বয়ের অভাবের কারণে নতুন প্রবর্তিত দারুল আরকাম মাদরাসাগুলো পুরো মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করবে। আলিয়া ও কওমি মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক ফাঁক-ফোঁকর রয়ে গেছে। সেখানে প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়নি। আমাদের মসজিদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে উচ্চ শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় দারুল আরকামের ভবিষ্যত কী হবে সেটা অস্পষ্ট। প্রকল্প শুরুর দুই বছরের মাথায় প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা সেই শঙ্কাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।