‘নিশ্চয়ই দুনিয়ার জীবন দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্ত নয়। আর এ কারণেই আল্লাহতায়ালা ধৈর্যের নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েতপ্রাপ্ত।’ -সূরা আল বাকারা: ১৫৫-১৫৭
বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই, ৯ জিলহজ) সৌদি আরবের আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরা থেকে দেওয়া হজের খুতবায় শায়েখ আবদুল্লাহ বিন সোলায়মান আল মানিয়া এসব কথা বলেন।
স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে বারোটায় হজের খুতবা শুরু হয়। ৩০ মিনিটব্যাপী খুতবায় দেশটির সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য শায়েখ মানিয়া বৈশ্বিক মহামারি থেকে মুক্তি, গোনাহ মাফ, আল্লাহর রহমত কামনাসহ সম-সাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন।
হজের খুতবায় খতিব মানিয়া বলেন, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো হজ। হজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। আর্থিক এবং শারীরিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হলেও হজ ফরজ করা হয়েছে। কারও হজ যদি কবুল হয়, তার জন্য আল্লাহতায়ালা পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করেছেন জান্নাত।
খুতবার শুরুতে তিনি আল্লাহতায়ালার প্রশংসা ও নবী করিস (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠ করে বলেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়! আমি তোমাদের প্রতি উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো। এর মাধ্যমে আপতিত সব আপদ-বিপদ তিনি দূর করে দেবেন। আল্লাহতায়ালাকে ভয় করার অর্থ হলো, সুখে-দুঃখে, শান্তিতে-অশান্তিতে আল্লাহতায়ালার কাছে সমর্পিত হওয়া। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তার কাছেই চাওয়া। পৃথিবীর কোনো সৃষ্টির কাছে না চাওয়া। এটাই কালিমার দাবি, ঈমানের দাবি।
কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা আল্লাহতায়ালার ইবাদত করো, তার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না।
তিনি বলেন, আল্লাহতায়ালার প্রতি, তার সৃষ্ট ফেরেশতাদের প্রতি, আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি, আগত সমস্ত নবী-রাসূলের প্রতি, কিয়ামত দিবসের প্রতি এবং ভালো-মন্দ যা কিছু হয়; তা আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে হয়, এই কথার ওপরে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।
খতিব বলেন, আল্লাহতায়ালা আমাদের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা দিয়েছেন। ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে নবী করিম (সা.) কোরআনে কারিমের আয়াত পড়েছিলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের ওপরে পরিপূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম ইসলাম ধর্মকে।’
শায়েখ মানিয়া বলেন, আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের আরেক জায়গায় বলেছেন, হে ইমানদারগণ! তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো, সবর এবং নামাজের মাধ্যমে। নিশ্চয়ই, আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।
হে মানবসম্প্রদায়! পৃথিবী দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্ত নয়। জীবনের পদে পদে আপদ-বিপদ আসবে। তখন আমাদের নিরাশ হলে চলবে না। ধৈর্যধারণ করে আল্লাহতায়ালার কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের ঈমানকে যাচাই করতে চান। ধৈর্যধারণ করে সেই পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি অবশ্যই তোমাদেরকে ভয় দিয়ে, ক্ষুধা দিয়ে এবং জান-মালকে সংকীর্ণ করে দিয়ে পরীক্ষা করব। সুসংবাদ ধৈর্যশীলদের জন্য।
হে মানবসম্প্রদায়! আল্লাহতায়ালার দয়া ও অনুগ্রহ অত্যন্ত প্রশস্ত। তিনি আমাদের জন্য সবকিছু সহজ করতে চান। পবিত্র কোরআনে আছে, প্রত্যেক কঠিনের সঙ্গেই সহজ রয়েছে। সাময়িক কিছু দুঃখ-দূর্দশা আমাদের জীবনে এলেও এর বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করবেন।
তিনি বলেন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালার বিধান মানা আমাদের জন্য আবশ্যক। যা হালাল তা উপার্জন করতে হবে। আর যা হারাম তা পরিত্যাগ করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আছে, আল্লাহতায়ালা ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং রিবা তথা সুদকে হারাম করেছেন। তাই সুদ-ঘুষ খাওয়া যাবে না।
অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ ভোগ করতে আল্লাহতায়ালা নিষেধ করেছেন। তাকদির আমাদের জন্য নির্ধারিত। মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করতে হবে। পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করা যাবে না। পরস্পরে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য বজায় রাখতে হবে। নারী-পুরুষ সবার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এটাই ইসলামের বিধান।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা তার ইবাদত করবে এবং মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ করবে। তাদের দু'জনের একজনকে বা দুজনকেই যদি বৃদ্ধ অবস্থায় পাও, তাহলে তাদের সামনে (তাদের আচরণে বিরক্ত হয়ে) উফ বলবে না এবং তাদেরকে ধমক দেবে না। বরং তাদের সঙ্গে নম্রভাবে কথা বলবে।
হে মানবসম্প্রদায়! আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে ন্যায় ও ইনসাফের নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামে মানবজাতির জন্য এমন বিধি-বিধান রাখা হয়েছে, যার মাধ্যমে সমশ্রেণির মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা আল্লাহতায়ালার রশিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো, ভেদাভেদ সৃষ্টি করো না।
বিদায় হজের ভাষণে নবী করিম (সা.) বলেছেন, সতর্ক হয়ে যাও; নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তোমাদের প্রতি তোমাদের রক্ত ও মালকে হারাম করে দিয়েছেন। যেমন তোমাদের এ দিন হারাম তোমাদের এই শহরে, তোমাদের এই মাসে।
হে মানবসম্প্রদায়! নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা কুষ্ঠরোগী দেখলে পলায়ন করো, যেমন বাঘ দেখলে পলায়ন করে থাকো। তেমনিভাবে, তোমাদের কোনো এলাকায় যদি মহামারি দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে বের হয়ো না এবং সেখানে প্রবেশ করো না।
এই হাদিসগুলোর প্রতি লক্ষ করে চলমান মহামারির কারণে সৌদি সরকার এবারের হজকে সীমিত পরিসরে আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেয়। খাদেমুল হারামাইন শরিফাইন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এবং তার সন্তান মোহাম্মদ বিন সালমানকে আল্লাহতায়ালা উত্তম বিনিময় দান করুন।
হে আল্লাহতায়ালার বান্দারা! আজকের এই আরাফার দিন, দোয়া কবুলের দিন। আমরা নিজেদের জন্য, অন্য সবার জন্য এবং মহামারি থেকে মুক্তির জন্য দোয়া করবো। আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেছেন, তোমাদের প্রতিপালক বলছেন, তোমরা আমার কাছে প্রার্থনা করো। আমি তোমাদের প্রার্থনাকে কবুল করবো।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের থাকে এ মহামারি দূর করে দিন, অসুস্থদের সুস্থ করে দিন এবং অসুস্থদের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িতদের সক্ষমতা দান করুন এবং সঠিক রোগের নির্ণয় ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উদ্ভাবনের তাওফিক দান করুন।
হে আল্লাহ! তোমার নেয়ামত দিয়ে তাদের ভরপুর করে দাও এবং তোমার অনুগ্রহে তাদেরকে ধন্য করো। হে আল্লাহ! তাদের অন্তরের মধ্যে ভালোবাসা এবং ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে দাও। তাদেরকে আল্লাহভীতি ও সৎকাজে সহযোগী বানাও; পাপাচার এবং সীমা ছাড়িয়ে যেয়ো না। হে আল্লাহ! তুমি তোমার অনুগ্রহ ও করুণায় আমাদেরকে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা দান করো।
অনুবাদ: মুহাম্মদ বিন ওয়াহিদ, তরুণ আলেম ও সংবাদকর্মী