বন্যার পর কুড়িগ্রাম, রংপুর ও লালমনিরহাটের তিস্তা বিধৌত চরাঞ্চলের প্রায় ৩ হাজার পরিবার এখন বাস্তুহারা। নদীগর্ভে বসত-ভিটা হারিয়ে তাদের কেউ আশ্রয় নিয়েছে তিস্তার বাঁধে। আবার কেউ স্কুল-কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। প্রতি বছর বন্যায় সৃষ্ট এসব সমস্যা ও দুর্ভোগ লাঘবে স্থায়ী সমাধান চান চরাঞ্চলের অসহায় নিঃস্ব মানুষরা।
নদী ভাঙন রোধে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিকল্পিত নদী শাসনের দাবি করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। আর নদী পাড়ের মানুষরা বলছেন, শুধু বন্যা বা বর্ষা মৌসুমে নয়, সারাবছরই নদী ভাঙন রোধে গুরুত্বারোপ করা উচিত। অন্যদিকে এবারের দীর্ঘস্থায়ী বন্যা পরিস্থিতির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভাঙন রক্ষায় বড় প্রকল্প গ্রহণে পরিকল্পনার কথা ভাবছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড।
রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তায় পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু সব জায়গায় এক রকম নয়। কোথাও পানি কমলে আবার অন্য কোথাও বাড়ছে। শুধু পানি বাড়া-কমাতেই থেমে নেই তিস্তা। বন্যার পানির তোড়জোড় অসংখ্য মানুষের ঘর-বাড়ি, ঠিকানা কেড়ে নিয়েও শান্ত হয়নি খরস্রোতা এই নদী।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে গঙ্গাচড়ার শংকরদহ গ্রামের অসহায় রাজু মিয়া বলেন, 'হামার কপাল পোড়া। কায়ো হামার কতা শোনে না। ঘরোত আগুন নাগলে, তাক নিবিয়া নতুন করি গড়া যায়। কিন্তুক নদী যদি ঘর-বাড়ি সোগকিছু নিয়্যা যায়, তাইলে আর ভাগ্যোত কি থাকে? একটা বাঁধ হইলে হামার এতো বড় ক্ষতি হইল না হয়।'
একই গ্রামের জব্বার, সুজন, রজব ও মোনায়েম জানান, 'নদী ভাঙন এলাকার মানুষের মতো অসহায় মানুষ আর কোথাও নেই। দিনরাত ভয় কাজ করে কখন নদী হানা দেয়। অনেক সময় হাজারো চেষ্টা করেও ঘর-বাড়ি বাঁচানো সম্ভব হয় না। যাদের একেবারে জায়গা নেই, তাদের কষ্ট তো সীমাহীন।'
সাম্প্রতিক দীর্ঘস্থায়ী এই বন্যায় রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে তিস্তা সংলগ্ন চরাঞ্চলে নদী ভাঙনে ভিটে বাড়ি হারিয়েছে প্রায় তিন-চার হাজার মানুষ। ঘরবাড়ি হারানোর পাশাপাশি ফসলি জমি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতি হওয়াতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
এদিকে যতই পানি কমছে ততই তীব্র হচ্ছে নদী ভাঙন। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ২৫ বছর পর পুরনো চ্যানেলে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি। বিলীন হয়েছে বেড়িবাঁধ, সহস্রাধিক মানুষের ঘরবাড়ি-জমি। হুমকিতে পড়েছে রংপুর ও লালমনিরহাট সড়ক। তিন বছর আগে নতুন এ চ্যানেলটি অস্তিত্বের জানান দিলেও অস্থায়ী প্রতিরোধের চেষ্টাতেই সীমাবদ্ধ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দৌড়ঝাঁপ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুর থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গঙ্গাচড়ার শংকরদহ গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে সরে গেছে তিস্তা নদীর মূল প্রবাহ। সেখান থেকে ৫ কিলোমিটার ঘুরে জয়রামওঝা নামকস্থানে আবার মূল প্রবাহে মিলিত হয়েছে তিস্তা। এতে বাম তীরের বেড়িবাঁধসহ নদীর পেটে গেছে অসংখ্য ঘরবাড়ি, কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি, মসজিদ-মন্দির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখন পুরনো গতিপথে সর্বনাশা তিস্তার চোখ পড়েছে রংপুর-লালমনিরহাট সড়কের দিকে।
গঙ্গাচড়া লহ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ্ আল হাদী বলেন, এবার বন্যায় পশ্চিম শংকরদহ গ্রাম বিলীনসহ মসজিদ, মাদ্রাসা, সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালর্ভাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবিলম্বে বামতীরে বাঁধ নির্মাণসহ তিস্তা নদী খনন করা না হলে নদী যেদিক পাবে সেদিক প্রবাহিত হবে। ফলে তিস্তা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
এদিকে তিস্তার ভাঙন রোধ ও স্থায়ী চরগুলো রক্ষায় নদীর দুই ধারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া আট হাজার কোটি টাকার কথা জানালেন এই প্রধান প্রকৌশলী। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা যায়নি বলে জানান তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতিপ্রকাশ ঘোষ বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করছি। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যা দূরীকরণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন হবে। এছাড়া এখন বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের প্রত্যেক ডিভিশনে বস্তা আছে। তাৎক্ষণিক ভাঙন রোধের জন্য এ জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে গৃহহীন হয়ে পড়ছে লক্ষাধিক পরিবার। একই সাথে গঙ্গাচড়ায় সৃষ্ট নতুন চ্যানেলটি ঠেকানো এবং বামতীরে বাঁধ নির্মাণ করা না গেলে তিস্তা নদীর মূল প্রবাহকে ঘিরে গড়ে ওঠা ডান তীর বাঁধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও শহর রক্ষা বাঁধ, বেড়িবাঁধসহ হাজার হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো অকার্যকর হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।