নিয়ন্ত্রণ সংস্থার উদাসীনতা, অনিয়ম দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বেড়েই চলেছে সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার মতো ঘটনা। এসব ঘটনা ঘটলেই তদন্ত কমিটি হয়, দফায় দফায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন, চলে সাক্ষ্য গ্রহণ, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়। আবার দোষী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হালকা শাস্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে সবকিছু শেষও হয়ে যায়।
কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনের দেয়া সুপারিশের আলোকে কোনো কিছুই করা হয় না। ফলে বারবার সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার মতো ঘটনা ঘটেই চলছে।
এ কারণে ব্যবস্থাপনার মৌলিক পরিবর্তন এই মুহূর্তেই কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া না হলে ইমেজ সংকটে পড়বে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র। আর এমনটাই ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে গত ১০ বছরে অন্তত চার দফা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছে পাঁচ কিশোর। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার তিন কিশোর খুন ও ১৫ জন আহত হওয়ার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
জানা গেছে, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে সারাদেশে দুটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালিত হয়। তার একটি যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র। আর অন্যটি গাজীপুরের টঙ্গীতে। যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ১৫০ জন বন্দীর থাকার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রটিতে এর প্রায় দ্বিগুণ বন্দী থাকে। ১৮ বছরের কম বয়সী অপরাধীদের আদালতের মাধ্যমে এই কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সংশোধনের জন্য তাদের এখানে রাখা হলেও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িতে পড়ছে তারা।
গত ১০ বছরে এই কেন্দ্রে অন্তত ৪ বার সহিংসতা ও বন্দীদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০১১ সালের ২৯ আগস্ট আকাশ (১২) নামে এক শিশুকে প্রথমে শ্বাসরোধ ও পরে টিনের টুকরো দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। নিহত আকাশকে ২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গা থেকে যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ২০১৯ সালের ৩০ জুন কেন্দ্রে বন্দী থাকা নূর ইসলাম (১৫) নামে এক শিশু আত্মহত্যা করে। নূর ইসলামকে চুরির মামলায় ওই বছরের ২২ মে গাইবান্ধা থেকে যশোরে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়াও ২০১৪ সালের ৫ মে কেন্দ্রে বন্দীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় কয়েক কিশোর ভাঙা কাঁচ দিয়ে শরীর কেটে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানায়। দর্শনার্থী একজন অভিভাবককে মারধরের অভিযোগের জের ধরে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছিল। ওই সময় বন্দী কিশোররা কেন্দ্রে ভাঙচুর ও পুলিশের ব্যারাকে হামলা চালায়। আর সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রের মধ্যে পিটিয়ে ৩ কিশোরকে হত্যা করেছে কর্তৃপক্ষ। এসময় আহত হয়েছে আরও ১৫ কিশোর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেন্দ্রে ১৮ বছরের কম বয়সীদের রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে এই নিয়ম কার্যকর হয় না। আদালতে বয়সের প্রমাণপত্র দেখিয়ে তারা এই কেন্দ্রে আসলেও প্রকৃত বয়স অনেকের ১৮ বছরের বেশি। এছাড়া এখানে দীর্ঘদিন থাকার পর বয়স ১৮ বছরের বেশি হলে জেলখানায় পাঠানোর নিয়ম। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতায় বছরের পর বছর যুবকরা এখানে থেকে যায়। তারাও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এছাড়াও খাবার সরবরাহে অনিয়ম, দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হলেও ঠিকমতো মনিটরিং হয় না। যদিও এর আগে গঠিত একটি কমিটি এসব অনিয়ম বন্ধে এক গুচ্ছ সুপারিশ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই বদলায়নি। আর এইসব কারণে বারবার সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। ব্যবস্থাপনায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় কেন্দ্রের ধারাবাহিক সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা এড়ানো সম্ভব নয়। সংস্কারের মাধ্যমেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন জানান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা জনবল সংকট। দক্ষ জনবলের অভাবে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। আইনগতভাবে ১৮ বছরের কম বয়সী বলা হলেও বাস্তবে ২০ বছরের উপরে বেশির ভাগ অপরাধী এই কেন্দ্রে আসে। এদের একটা বড় অংশ অল্প বয়সে ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। তারা কেন্দ্রের অভ্যন্তরেও আধিপত্য বিস্তার করে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরাও নিরস্ত্র। তারাও অনেক সময় অপরাধীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে। টাকার বিনিময়ে মাদকও সরবরাহ করে থাকে। কর্মকর্তাদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করে অপরাধীরা। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দী থাকায় কর্মকর্তারাও অসহায় হয়ে পড়েন। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও সমাধান হয়নি।
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সাবেক ওই কর্মকর্তা ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অনেকগুলো কারণে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা হয়ে থাকে। প্রথমত, কেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা নিরস্ত্র আনসার সদস্যদের অধিকাংশের শারীরিক ফিটনেস নেই। কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে তারা প্রশিক্ষিতও না। সঙ্গত কারণে তারা ‘শরীরের জোরে’ বন্দীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ফলে সব সময় গার্ড আর বন্দীদের মধ্যে একটা বিরোধ লেগেই থাকে। এজন্য মাঝে মধ্যেই হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। একই সঙ্গে কম বেতনে চাকরি করা আনসার সদস্যরা টাকার বিনিময়ে বন্দীদের কাছে মাদক পৌঁছে দেয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও কেন্দ্রের সাবেক কর্মকর্তাদের দাবি, দেশের বিভিন্ন এলাকার কিশোর অপরাধীরা আদালতের মাধ্যমে এই কেন্দ্রে আসে। এর মধ্যে অনেকে হত্যা, বোমাবাজি, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু কেন্দ্রের মধ্যে তাদের মানসিক চিকিৎসার ‘কার্যকরী ব্যবস্থা’ না থাকায় বন্দী অবস্থায় তারা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। এ নিয়ে দুই পক্ষের ভেতরে মাঝে মধ্যে মারপিটের ঘটনা ঘটে। তাদের কাছে কর্মকর্তারাও মাঝে মধ্যে লাঞ্ছিত হন। তাই কর্মকর্তারা নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক সময় কিশোর গ্রুপের কোনো একজনকে নিজের ছত্রছায়ায় রাখেন। যারা আবার ক্ষমতার প্রভাবে অন্য কিশোরদের উপর নিয়মিত নির্যাতন চালায়। মূলত কর্মকর্তাদের মদদে তারা কেন্দ্রের মধ্যে আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় চলা ৭-৮ বন্দীর নেতৃত্বে ১৮ জন কিশোরের উপর নির্যাতন চালানো হয়। এর আগেও একই ঘটনা ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বার্তা২৪.কমকে জানান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নানা অসঙ্গতির বিষয় সামনে আসছে। সেই বিষয়গুলো ইতোমধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। এই ধরনের সহিংসতার ঘটনা যাতে আগামীতে আর না ঘটে, সেই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।
আরও পড়ুন: যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সংঘর্ষে তিন কিশোর নিহত, আহত ১৪
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী পরিচালকসহ ১০ কর্মকর্তা পুলিশ হেফাজতে
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ৩ কিশোর নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি
৩ কিশোরকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা!