'ধার দেনা করি বন্দকি জমিত রোপা আমন নাগাইচি। তাকো তো ফির বন্যার পানিত ডুবছে। এ বছর আবাদ সুবাদ ভালো হওচে না। আগের মতো ব্যবসাও নাই। বার বার বন্যা হইলে হামরা ক্যামন করি বাঁচমো?'- এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নাজিউর রহমান। তিনি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের পাঠকশিকড় গ্রামের বাসিন্দা।
নাজিউর রহমানের মতো অসংখ্য কৃষকের স্বপ্ন এখন বন্যার পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। চারবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা এখন দিশেহারা। শুধু পাঠক শিকড় গ্রামই নয়, পাশের দাদান, পূর্বপাঠক শিকড়, ছাওলা ইউনিয়নের গাবুড়া, কৈকুড়ী ইউনিয়নের মকরমপুর গ্রামেও বন্যা পানির নিচে তলিয়ে আছে রোপা আমন। ভালো নেই রবিশস্য ফসল উৎপাদনকারী কৃষকরাও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা ও ঘাঘট নদী নিকটবর্তী পীরগাছা উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে কোথাও হাঁটু, আবার কোথাও কোমর পানিতে রয়েছে। এবার ঘাঘট উপচে সৃষ্ট বন্যা ১৯৮৮ সালের বন্যা পরিস্থিতিকেও হার মানিয়েছে। গ্রামের নিচু রাস্তাঘাট পানিতে টইটম্বুর। কোথাও কোথাও মানুষ বাড়িঘরে এখনো পানিবন্দি। রোপা আমনসহ রবিশস্য পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে ছোট-বড় পুকুরসহ অসংখ্য মৎস্য খামারের মাছ।
কান্দি বাজার এলাকার সাজু মিয়া জানান, 'এক সপ্তাহের বেশি রোপা আমন খেত পানিতে ডুবে আছে। বাড়ির পিছনের খোলা জায়গাতে শাক-সবজির আবাদ নষ্ট হয়েছে। বৃষ্টি আর উজানের ঢলে ঘাঘট নদীটি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। পাড় উপচে ফসলের মাঠে ও লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ছে।'
সৃষ্ট বন্যায় আমন চাষিরাসহ সাধারণ মানুষের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য ঘাঘট নদীর দখল ও অতিবর্ষণকে দুষছেন স্থানীয় সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম জুয়েল। তিনি জানান, পীরগাছা ও মিঠাপুকুর উপজেলার মাঝ দিয়ে ঘাঘট নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৩৬ কিলোমিটার। এর পানি প্রবাহমাত্রা অবস্থাভেদে ৫০ থেকে আড়াই হাজার কিউসেক। দখল হয়ে যাওয়ায় ৫০ ফুট প্রশস্ত ঘাঘট এখন ১০ ফুটে এসে ঠেকেছে।
তিনি জানান, গত সপ্তাহের টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢলে ঘাঘট ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। এতে করে পাড় উপচে ফসলের মাঠে ও লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক স্থানে এখনো রোপা আমন খেতসহ রবিশস্য ডুবে আছে।
এ ব্যাপারে পীরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শামীমুর রহমান জানান, চলতি মৌসুমে ২০ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমান পানিতে তলিয়ে গেছে। ১০০ হেক্টর রবিশস্য পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
পীরগাছার মতো জেলার রংপুর সদর, মিঠাপুকুর, কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া, পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলাতেও রোপা আমন খেতের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এখনো বেশ কিছু এলাকায় বন্যার পানিতে কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে আছে।
রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার ৩১নং ওয়ার্ডের হোসেননগর গ্রামের কৃষক মিয়া মোহাম্মদ সোহেল ও রশীদ হারুন জানান, গত শনিবার রাতের ভারি বর্ষণ আর সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় সেখানকার বেশির ভাগ এলাকার রাস্তাঘাট এখনো পানিতে থৈ থৈ করছে। ফসলি জমিতে কোমর পানি। এতে করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রোপা আমন চাষিরা।
এদিকে কৃষি বিভাগ বলছে, আমনের জমি থেকে দ্রুত পানি সরে গেলে কৃষক ক্ষতির মুখ থেকে অনেকটা রেহাই পাবে। অনেক এলাকা থেকে পানি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে পানি সরে গেলে ফসলের খুব একটা ক্ষতি হবে না।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মো. সরওয়ারুল হক জানান, এবার রংপুর জেলায় ১ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় দেড় হাজার হেক্টরসহ জেলার আট উপজেলাতে প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর আমন ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। আর ৬ হাজার ২০০ হেক্টর শাক-সবজির মধ্যে ১৪০০ হেক্টর জমির শাক-সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।