বেনাপোলে রেলপথে বাণিজ্যে আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা

, জাতীয়

আজিজুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বেনাপোল (যশোর) | 2023-08-24 11:43:19

বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে রেলপথে ব্যবসায়ীদের আরও বেশি পণ্য আমদানি ও রফতানির চাহিদা থাকলেও কেবল অবকাঠামাগত সমস্যায় বাণিজ্য প্রসারে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও রেলে লাগেনি উন্নয়নের তেমন কোন ছোঁয়া। ফলে ব্যবসায়ীরা এপথে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতে সরকারও হারাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব। তবে দুর্বল অবকাঠামোর কথা স্বীকার করে উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ।

বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বার্তা২৪.কম-কে জানান, দেশের একমাত্র ব্যতিক্রম বন্দর বেনাপোল। যে বন্দরটি দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে একই সাথে রেল ও স্থলপথে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সম্পাদন এবং পাসপোর্ট যাত্রী যাতায়াত হয়ে থাকে। তবে বাণিজ্য সম্প্রসারণে এরুটে স্থলপথে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে অবকাঠামো গড়ে উঠলেও রেলপথে উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি। ফলে বাণিজ্য প্রসারে বিঘ্ন ঘটছে। সংকীর্ণ রেলপথের পাশাপাশি কনটেইনার টার্মিনাল, ইয়ার্ড ও পর্যাপ্ত ইঞ্জিন না থাকায় পণ্যবাহী রেল কার্গো নিয়ে দিনের পর দিন ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা করতে হয়।

এছাড়া রেলে আমদানি হওয়া সব ধরনের পণ্য বেনাপোলে খালাসের ব্যবস্থা না থাকায় ৬০ কিলোমিটার দূরে নওয়াপাড়ায় নিয়ে খালাস করতে হয়। ফলে ভোগান্তির পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হয় ব্যবসায়ীদের। এতে এপথে আমদানি বিমুখ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্নভাবে যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে স্বাভাবিক বাণিজ্যের ওপর। অবকাঠামো বাড়ানো হলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে বেনাপোল রেলপথ।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান জানান, বেনাপোল বন্দরের রেলপথে একই সাথে ভারতের সঙ্গে
আমদানি বাণিজ্য ও পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত হচ্ছে। এছাড়া এপথে ঢাকা-বেনাপোল আন্তনগর, খুলনা-বেনাপোল কমিউনিটি রেলও চলাচল করছে। কিন্তু রেল স্টেশনে পর্যাপ্ত ইয়ার্ড না থাকায় ইচ্ছে মতো রেল এখানে প্রবেশ করতে পারে না। এতে যেমন বিলম্ব ঘটছে স্বাভাবিক বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে তেমন যাত্রী
যাতায়াতে।

রফতানিকারক তৌহিদুজ্জামান জানান, কেবল অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে রেলপথে বাণিজ্য প্রসার হচ্ছে না। এখন রেলপথে শুধু আমদানি বাণিজ্য চলছে, সেবার মান বাড়ালে এপথে রফতানি বাণিজ্যেও আগ্রহী হবেন ব্যবসায়ীরা। ফলে পণ্য পরিবহন খরচ যেমন কমবে তেমনি সরকারের রফতানি খাতে অর্জনও বাড়বে।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বার্তা২৪.কম-কে জানান, আগে বেনাপোল দিয়ে কেবল কার্গো রেলে পণ্য আমদানি হতো। এখন সাইড ডোর কনটেইনারে ও পার্সেল রেলের মাধ্যমে পণ্য আমদানি হচ্ছে। এটি বাণিজ্যেরে ক্ষেত্রে সরকারের মাইলফলক। তবে বন্দরে যদি কনটেইনারে টার্মিনাল ও ইয়ার্ড চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন ব্যবসায়ীরা। বছরে দশ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় কঠিন হবে না।

ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কমিটির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বার্তা২৪.কম-কে জানান, দেশের স্থলপথে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি-রফতানি হয় তার ৭০ শতাংশ হয়ে থাকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে। এসব পণ্যের মধ্যে অধিকাংশ থাকে শিল্পকারখানার কাঁচামাল। ট্রাক যোগে পণ্য বেনাপোল বন্দর থেকে ঢাকায় নিতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কখনো নানান প্রতিবন্ধকতায় দুই দিন পর্যন্ত লেগে যায়। এতে সময় মতো গন্তব্যে পণ্য না পৌঁছানোয় শিল্প কলকারখানার উৎপাদন কাজ ব্যাহত হয়ে থাকে। এছাড়া কয়েক বছরের মধ্যেই চালু হচ্ছে পদ্মা সেতু। তখন রেলে কম সময়ে অল্প খরচে নিরাপদভাবে পণ্য গন্তব্যে নেওয়া যাবে। তাই এখন থেকেই রেলের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব আরও বাড়াতে হবে।

ভারতীয় পণ্যবাহী কার্গো রেল পরিচালক উত্তম মল্লিক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, তিনি কয়েক বছর হচ্ছে বেনাপোলে রেলে পণ্য নিয়ে আসছেন। তবে এখানকার অবকাঠামো উন্নত না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা অন্যপথে ঝুঁকছে। রেলপথ প্রশস্ত করা হলে এপথে আরও বেশি পণ্য আমদানি সম্ভব।

বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার আজিজুর রহমান জানান, করোনায় সড়ক পথে নানান প্রতিবন্ধকতায় থমকে গিয়েছিল ভারতের সাথে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। সবার প্রচেষ্টায় রেলে চালু করা হয় সব ধরনের পণ্য আমদানি। আমদানি পণ্য থেকে গত তিন মাসে প্রায় ৩শ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ হয়েছে। প্রয়োজনীয় সব ধরনের অবকাঠামো স্থাপন হলে এপথে আরও আমদানি বাড়ার সুযোগ রয়েছে।

বেনাপোল স্থবন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার বার্তা২৪.কম-কে জানান, রেলের কিছু পণ্য বন্দরে খালাস হচ্ছে। তবে আমদানিকৃত সব পণ্য খালাসের সুবির্ধাতে যাতে বন্দরে কনটেইনার টার্মিনালসহ অন্যান্য সুবিধা স্থাপন হয় তার জন্য নৌ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশিষ্ট বিভিন্ন দফতরে অবহিত করা হয়েছে।

বেনাপোল রেল স্টেশন মাস্টার সাইদুর রহমান বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রেলের নাজুক অবকাঠামোর কথা স্বীকার করে বার্তা২৪.কম-কে জানান, বাণিজ্য সম্প্রসারণে ইতিমধ্যে তিন কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে বেনাপোল বন্দরের পাশে অতিরিক্ত দুটি লাইন বসানোর কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে আরও রেললাইন সম্প্রসারণ, ইঞ্জিন বাড়ানো ও ইয়ার্ডসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা রেলের রয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে বেনাপোল দিয়ে রেলপথে ভারতের সাথে আমদানি বাণিজ্য শুরু হয়। চলতি অর্থবছরের গত ৬ মাসে বেনাপোল রেলপথে ভারত থেকে ২ লাখ ৭১ হাজার ৮৭৯ মে.টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। রেলের ভাড়া বাবদ সরকারের আয় হয়েছে ১২ কোটি টাকা। রেলপথে আমদানি পণ্যের মধ্যে শিল্পকারখানার কাঁচামাল, গার্মেন্টস, কেমিকেল, ট্রাক চ্যাচিজ, ফ্লাইঅ্যাস, তুলা, পাথর, জিবসাম ইত্যাদি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর