গেলো কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আবাদ বাড়লেও চলতি মৌসুমে গাজরের আবাদ কমেছে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায়। তবে আবাদ কমলেও বেড়েছে ফলনের লক্ষমাত্রা। পাইকারি বাজারে চাহিদা ও বাজারদর ভালো থাকায় চলতি মৌসুমে গাজর চাষাবাদে লাভবান মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার কৃষকেরা।
রাজধানীর সাথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচা বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের বাড়তি নজরও রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার থেকে মধ্যমাচ্যের বিভিন্ন দেশেও সিংগাইর উপজেলার গাজর রফতানি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার অধিকাংশ মাটি বেলে-দোঁআশ। গাজর চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত এই মাটি। গাজর চাষাবাদের জন্য আশ্বিন-কার্তিক মাসে জমিতে বীজ বপন করেন কৃষকেরা। পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে বিক্রয় উপযোগী হয়ে যায় গাজর।
স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে বিক্রয় উপযোগী হয়ে যাওয়ার আগেই জমি থেকে গাজর ক্রয় করেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। বাড়তি মুনাফার আশায় অনেক কৃষক আবার নিজ উদ্যোগে রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে বিক্রি করেন নিজেদের উৎপাদিত গাজর। প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত জমি থেকে গাজর সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করেন কৃষক ও কৃষি শ্রমিকেরা।
এরপর নির্ধারিত জায়গায় বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাজর থেকে মাটি/ময়লা পরিষ্কার করা হয়। সেখান থেকে বস্তায় ভরে চাহিদা অনুযায়ী পাঠানো হয় রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে। গাজর উৎপাদনে কৃষকদের পাশাপাশি ভাগ্যবদল হয়েছে এলাকার কয়েক’শ কৃষি শ্রমিকেরও।
জানা গেছে, প্রতিদিন সাড়ে ৪৫০-৫৫০ টাকা দৈনিক মুজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন এসব কৃষি শ্রমিকেরা। সিংগাইর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকার সবজি ব্যবসায়ীদের পদচারনায় এখন মুখোরিত সিংগাইর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম। মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশেও সিংগাইর উপজেলার গাজর রফতানি করা হয় বলে দাবি স্থানীয় কৃষকদের।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সিংগাইরে এক হাজার ১০২ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৩৮ হাজার ৫৭১ টন গাজর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক হাজার ১১০ হেক্টর জমি থেকে সংগ্রহ করা হয় ৪২ হাজার ১৮০ টন গাজর। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ১১৭ হেক্টর জমি থেকে উৎপাদন হয় ৪২ হাজার ৭২৫ টন। চলতি বছরে এক হাজার ৭৭ হেক্টর জমিতে জমি থেকে গাজর উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৩ হাজার টন।
উপজেলার চান্দহর ইউনিয়নের মানিকনগর এলাকার কৃষক আলম মিয়া বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে গাজর চাষাবাদে ১৯-২০ হাজার টাকা খরচ হয়। ফলন ও বাজারদর স্বাভাবিক থাকলে ওই জমি থেকে ৬৫-৭০ হাজার টাকার গাজর বিক্রি করা যায় অনায়াসে। তবে জমি থেকে সরাসরি পাইকারদের নিকট বিক্রি করলে মুনাফা আরেকটু কম হয়।’
উপজেলার জয়মন্টপ ইউনিয়নের পশ্চিম ভাকুম এলাকার কৃষক আফজাল হোসেন মোল্লা বলেন, ‘স্থানীয় বাজারে গাজরের চাহিদা কিছুটা কম থাকলেও ঢাকার পাইকারদের নিকট সিংগাইরের গাজরের বেশ চাহিদা রয়েছে। এছাড়া অল্প খরচে মাত্র আড়াই থেকে তিন মাস সময়ের মধ্যে অন্যান্য ফসলের তুলনায় গাজর চাষাবাদে মুনাফাও বেশি।’
উপজেলার জয়মন্টপ এলাকায় আলাপ হলে ব্যবসায়ী মোকলেছুর রহমান বলেন, ‘রাজধানীর সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সিংগাইরের গাজরের প্রতি পাইকারদের নজর বেশি। রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার থেকে সিংগাইর উপজেলার গাজর মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। সবমিলিয়ে গাজর চাষাবাদে কৃষকদের সাথে পাইকারেরাও বেশ লাভবান হন।’
শ্রমিক আলফাজ উদ্দিন বলেন, ‘জমি থেকে গাজর উঠানো এবং পরিষ্কার করার কাজ করি। গাজর উঠানো এবং পরিষ্কারের কাজে কষ্ট বেশি বলে পারিশ্রমিকও বেশি।’
সিংগাইর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. টিপু সুলতান স্বপন বলেন, ‘গাজর চাষাবাদের জন্য জাপানের অরেঞ্জ কিং জাতের বীজ নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করে বপন করেন স্থানীয় কৃষকেরা। এক বিঘা জমিতে স্বাভাবিকভাবে ১৫০-১৬০ মণ গাজরের ফলন পাওয়া যায়। তবে ফলন ভালো হলে ২২০-২৩০ মণ গাজরও পাওয়া যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বন্যার কারণে সিংগাইরে গাজর আবাদের পরিমান কিছুটা কমেছে। এছাড়াও পেঁপে চাষাবাদের জমি বাড়ছে। তবে গাজর আবাদের জমি কমলেও চলতি মৌসুমে ৪৩ হাজার টন গাজর উৎপাদন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’