একদল তরুণের ভিন্নরকম আয়োজনে হাজার মুখের হাসি

, জাতীয়

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 23:59:14

কোন রাজনীতি নয়, নয় কোন এনজিও'র কাজ স্রেফ স্বেচ্ছা শ্রম দিয়ে হাজারো মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলছে একদল তরুণ। করোনা অতিমারির মধ্যে কর্ম হারিয়ে অনেকে চরম বিপাকে পড়েছে। অনেক রিকশা চালক, নিম্ন আয়ের মানুষেরা আহার জুটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই বড় কিছু করতে না পারলেও কিছু মানুষকে একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা থেকে মেহমানখানা করার উদ্যেগ নেন কয়েকজন তরুণ।

তাদের মধ্যে অন্যতম সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন ও আসমা আকতার লিজা। বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নয়, নেই কোন লক্ষ্য পথের রিকশা চালকরা যেন একবেলা পেট ভরে খেতে পারে এটাই তাদের স্বপ্ন। প্রথমে নিজেদের টাকা দিয়ে স্বল্প পরিসরে শুরু করেন, এরপর তাদের এই মহতী উদ্যোগে অনেকে এগিয়ে আসেন। তবে কেউ বেশি কিছু দিতে চাইলে সেটা নেন না ওই তরুণ উদ্যোক্তরা।

সরকার ঘোষিত লকডাউনের শুরু থেকে চলছে তাদের এই মেহমানদারি। সেখানে রিকশাচালক থেকে শুরু করে পথশিশু, পথচারী যেই আসবে সবাই তাদের মেহমান। আসলে একবেলা খেয়ে চলে যান। বিকেল ৫টার পর রাজধানীর লালমাটিয়া ডি ব্লকের ওলি গলি মেহমানে ভরপুর হয়ে যায়। রিকশাচালকরা সারাদিন রিকশা চালিয়ে বিকেলে ক্লান্ত শরীরে এসে হাজির হন মেহমান খানায়।

মেহমান খানা

এসে সারিবদ্ধভাবে রিকশা রেখে বসে থাকেন রিকশাতেই। ইফতারের আগে মেহমানদের হাতে একটা করে মগ ও এক প্লেট ইফতারি তুলে দেন স্বেচ্ছাসেবকরা। কোন রিকশা চালকে এসে লাইনে দাঁড়াতে হয় না, স্বেচ্ছাসেবকরাই খাবার নিয়ে চলে যান তাদের কাছে। মগ ভর্তি লেবুর শরবত আর নানা পদের ইফতারিতে মুহূর্তেই সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যান রিকশাচালকরা।

তৃপ্তিসহকারে মেহমান খানার খাবার খেয়ে চোখে মুখে মুহূর্তেই আনন্দের হাসি দেখা যায় এসব রিকশাচালক ও পথশিশুদের মাঝে।

মজার ব্যাপার হলো এতোগুলো লোকের আয়োজন অথচ কোথাও এক মিনিটের জন্য হৈ চৈ বা হট্টগোল নেই। রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশায় বসেই খাবার সারছেন তারা। খাবার শেষে ফুটপাতেই রেখে যাচ্ছেন প্লেট ও মগ। আবার স্বেচ্ছাসেবকরা সেগুলো গুছিয়ে এনে ধুয়ে পরিষ্কার করে প্যাকেট করে রাখছেন পরবর্তী দিনের জন্য। এভাবে প্রতিদিন চলে তাদের মেহমানদারি।

ভিন্নধর্মী এ আয়োজনের স্বপ্নদ্রষ্টা সৈয়দ সাইফুল আলম সোভন বার্তা২৪কম-কে বলেন, এটা শুধু রোজা কেন্দ্রিক না। আমরা গত বছরও লকডাউনের সময় রিকশা চালক ও পথশিশুদের খাবারের ব্যবস্থা করেছি এবারও করছি। আমাদের কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নাই, লকডাউনে অনেক মানুষের খাবার কষ্ট হয়। আমরা বড় কিছু করতে পারি না তবে একবেলা এসব অসহায় মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পেরে নিজেরা আনন্দ পাই।

 সারিবদ্ধভাবে রিকশা রেখে বসে থাকেন রিকশাতেই

এতো বড় আয়োজন অর্থের যোগান হয় কিভাবে জানতে চাইলে বলেন, এখানে আমাদের তেমন অর্থ এখন লাগে না। শহরের অনেক মহৎ লোক আছেন তারা এগিয়ে আসেন। কেউ দুই কেজি চাল, কেউ তেল আবার কেউ চিনি বা অন্যান্য জিনিস দিয়ে সহযোগিতা করছেন। আমরা শুধু গুছিয়ে রান্না করে মেহমানদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছি। এখানে যারা কাজ করছে প্রত্যেকে নিজ উদ্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কাউকে কোন পারিশ্রমিক দিতে হয় না কাউকে ডাকতেও হয় না প্রত্যেকে নিজ দায়িত্বে কাজ করেন।

তিনি বলেন, অনেকে আমাদের এই উদ্যোগ দেখে আর্থিকভাবে মাসব্যাপী সহযোগিতা করার কথা বলেছেন তাদের কাছ থেকে কোন টাকা নিতে পারব না বলে জানিয়ে দিয়েছি। আমরা কারো কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ বা এক সাথে অনেক চিনি, ছোলা বা তেল নেই না। কারণ আমরা চাই সবাই যার যার সামর্থ অনুযায়ী সহযোগিতা করুক। কোন একটি প্রতিষ্ঠান বা কোন বিশেষ ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ বা জিনিসপত্র নিলে অন্যদের বঞ্চিত করা হবে। তাছাড়া একজনের কাছ থেকে বেশি টাকা নিলে তখন নানা প্রশ্নও উঠতে পারে। তাছাড়া আমরা কোন কিছু মজুদ করি না। দিনেরটা দিনে শেষ করার চেষ্টা করি যদি কোন ছোলা, চিনি বা খেজুর অবশিষ্ট থাকে তাহলে পরেরদিন কম বাজার করে সেটা দিয়ে দেই। আমরা চাই মানুষের টাকা মানুষের জন্য পুরোটাই ব্যয় করে দিতে।

স্বেচ্ছাসেবকরা প্লেট গুছিয়ে এনে ধুয়ে পরিষ্কার করে প্যাকেট করে রাখেন

মেহমান খানার খাবার খেয়ে রিকশা চালক হেলাল মিয়া বার্তা২৪কম-কে বলেন, আমি আজসহ দুই দিন এখানে আসলাম। এর আগে এই রাস্তা দিয়ে খ্যাপ নিয়ে যাওয়ার সময় দেখি রিকশা চালকরা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে আমি আসছি। অনেক সুন্দর আয়োজন। এখানকার খাবার খেয়ে রাতে আর খেতে হয় না। ইফতারের সাথে খিচুড়ি থাকে। এছাড়া রোজা না থাকলে নাকি ভাত, মাছ, মাংস দিয়েও খাবার দেয়। যারা এরকম কাজ করছেন তাদের জন্য অনেক দোয়া করি।

মঙ্গলবার (০৪ এপ্রিল) মেহমান খানা ঘুরে দেখা যায় কয়েক গলির দুই পাশে সারি সারি রিকশা। আর বিকেল থেকে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করা শ্রমিক ও পথচারীদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। সবার জন্য একই খাবার একই শরবত। এখানে কেউ উঁচু নিচু নেই সবাই সমান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর