অবশেষে দুই যুগ পর ভাঙল ‘কালিতলা পার্কিং সিন্ডিকেট’

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বেনাপোল (যশোর) | 2023-08-31 14:07:04

অবশেষে দুই যুগ পর ভারতের কালিতলা পার্কিংয়ের সিন্ডিকেট কবল থেকে মুক্তি মিলেছে আমদানিকারকদের। পেট্রাপোলে দালাল চক্রের গাড়ি পার্কিং নিয়ে রমরমা ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় দেড় মাস থেকে কমে এখন তিন দিনেই ট্রাক ঢুকছে বাংলাদেশে। বনগাঁ পৌরসভার হাত থেকে নিয়ে সেই দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে পরিবহন দফতরকে। এই সিদ্ধান্তেই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে পেট্রাপোল ও বেনাপোল সীমান্তের।

আগে এক থেকে দেড় মাস সীমান্তে আটকে থাকত পণ্যবাহী গাড়ি। এখন প্রায় দিনের দিনই মালপত্র নিয়ে বাংলাদেশ ঢুকছে ভারতীয় ট্রাক। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ-ভারত সকল ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীরা। তাদের বক্তব্য, গত দুই যুগ ধরে দুষ্টচক্রের জাঁতাকলে ফেঁসে দিনের পর দিন পণ্যবাহী ট্রাক আটকে থাকতে হতো সীমান্তে। ভারতের রাজ্য সরকারের নয়া সিদ্ধান্তে এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোল সিন্ডিকেটের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে।

বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন, একটা সময় কোনও পণ্যবাহী ট্রাক এন্ট্রি নেওয়ার পর প্রায় ৩৯ দিন আটকে থাকতো। তারপরও দালালদের টাকা দিয়ে ঢুকতো বাংলাদেশে। ব্যবস্থা পাল্টাতে মাস্টার স্ট্রোক দেয় ভারত রাজ্য সরকার। পৌরসভার হাত থেকে পার্কিং নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কেড়ে তা তুলে দেওয়া হয় পরিবহন দফতরের হাতে। নয়া সিদ্ধান্তের পর দেখা গিয়েছে, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আটকে থাকা গাড়ি এবং দিন সংখ্যা ভালো রকম হ্রাস পেয়েছে। এখন ৩৯ দিন নয়, তা কমে তিনদিনে নেমে এসেছে, বলছেন চালকরা। চলতি সপ্তাহে তা আরও কমে আসবে। এন্ট্রি হওয়ার দিনই গাড়ি ঢুকছে বাংলাদেশ । আগের ব্যবস্থায় দিন প্রতি পণ্যবাহী গাড়ির এন্ট্রি হতো ৮৪৬টি করে। বর্তমানে তা কমে ২৯৯টি হয়েছে। আগে লাইনে পণ্যবাহী গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত ৯ হাজারের মতো। নয়া ব্যবস্থার পর তা কমে ১ হাজার ৫৮৭টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে বাণিজ্যে স্বস্তি ফিরেছে।

সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী জানান, সরকারের এমন পদক্ষেপে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে স্বস্তি ফিরেছে আমদানিকারকদের মাঝে। দ্রুত পরিবহন করা যাচ্ছে পণ্য। এতে বাণিজ্য সহজ হয়েছে।

ভারতীয় ট্রাক চালক অনিমেষ জানান, আগে দেড় মাস পর্যন্ত কালিতলা পার্কিংয়ে থাকতে হতো। এখন ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে ঢোকা যাচ্ছে। দ্রূত পণ্য পৌঁছাচ্ছে বন্দরে।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশেন সহসভাপতি কামাল হোসেন জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এমন উদ্যোগে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা খুশি। তবে ট্রাক প্রতি এ ধরনের সেবা চার্জ পণ্যবাহী ট্রাক ১০ হাজার রুপি ও ট্রাক চ্যাচিজ চার্জ ৫ হাজার রুপি নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থের পরিমাণ কিছুটা কমালে আরও উপকৃত হবেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ-ভারত ল্যান্ড পোর্ট চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, পণ্যের মূল্য ও ট্রাক ভাড়া ছাড়া প্রতি বছর কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা শুধু কালিতলা পার্কিং ডিটেনশন চার্জ বাবদ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সদ্বিচ্ছা ও মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে বনগাঁ কালিতলা পার্কিং সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হয়। দিল্লি, বোম্বে সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হতে একটি ট্রাক আসার পর লোকাল গোডাউনে আনলোড করে রাখা হয়। পরবর্তীতে সেই একই পণ্য দুইটি ট্রাকে লোড করে বেনাপোলে পাঠানো হয় যা ঋণ পত্রের শর্ত বহির্ভূত। এলসি তে পার্ট শিপমেন্ট অনুমোদন থাকলেও ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকে। বনগাঁ পার্কিং সিন্ডিকেট ট্রাকের ভুয়া নম্বর দিয়ে এন্ট্রি করে রাখা হত। পরবর্তীতে সেই সিরিয়াল নম্বর ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হত।

তিনি বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন পণ্যের ইনভয়েজের মূল্যের সঙ্গে মালবাহী ট্রাকের চার্জের উল্লেখ করা হয়েছে। তা বিশ্লেষণ করে যায়, একটি গ্লশ ইন্ড্রাস্টিজের আমদানি করা কেমিক্যাল ব্রীক্স ৪টি ট্রাকে আমদানি হয়েছে। সেখানে ডিটেনশনসহ মালবাহী চার্জ ৮ হাজার ডলার অর্থাৎ একটি ট্রাকের ভাড়া ও ডিটেনশন চার্জ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা। আবার সে ভাড়া পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যোগ করে শুল্ক পরিশোধ করা হয়।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, একটি ওষধ শিল্পের ২ টন পণ্য আমদানি হয়েছে, যার ডিটেনশনসহ মালবাহী চার্জ ৩ হাজার ১০০ ডলার। অর্থাৎ একটি ট্রাকের ভাড়া ২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। আবার একটি ইলেকট্রনিকস প্রতিষ্ঠানের নামে ১২০টি কেমিক্যাল চালানের ডিটেনশনসহ মালবাহি চার্জ ৩ হাজার ২০০ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা।

ভারতের যে কোনো প্রদেশ হতে বেনাপোলে পণ্য আসলে সাধারণত ডিটেনশন ছাড়া দেড় লাখ টাকা ভাড়া হয় জানিয়ে মতিয়ার রহমান বলেন, পশ্চিম বাংলা সরকারের পরিবহন দফতর অনলাইনে স্লট বুকিং চালু করায় ভারতের যেকোনো প্রদেশ হতে ট্রাক কলকাতায় এসে পৌঁছানোর পর ১ থেকে ২ দিনের মধ্যে বেনাপোলে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে খুশি ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে উভয় দিকে সরকারি কর্মকর্তারা বিশেষ করে ভারতীয় পরিবহন দফতর, বন্দর কাস্টমস এবং বেনাপোল কাস্টমসও পোর্ট এলপিআই নিয়মিত তদারকি করলে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশে বনগাঁ পার্কিং সিন্ডিকেটের ডিটেনশন হতে চিরতরে মুক্তি পাবে এবং বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা উপকৃত হবে বলে আশা করেন তিনি।

অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ভুয়া এন্ট্রি বন্ধ হওয়ায় এখন দু থেকে তিনদিনের মধ্যে গাড়ি বাংলাদেশ পৌঁছে যাচ্ছে। আগামী দিনে এই বন্দরে কাজের পরিমাণও বাড়বে। রফতানি বাণিজ্য করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীদের উৎসাহ বাড়বে বলে মনে করছেন শুল্ক দফতরের আধিকারিকরাও।

বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার বলেন, দুই দেশের সরকারের চেষ্টায় ভারতের রাজ্য সরকারের নতুন নির্দেশে পেট্রাপোলের আমদানি বাণিজ্যে গতি এসেছে বেনাপোলে। এতে বাণিজ্যে গতি ফিরেছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর