ডেইরি শিল্পের উন্নয়নে ক্লাস্টার নেটওয়ার্কিংয়ের পথে বাংলাদেশ

, জাতীয়

তরিকুল ইসলাম সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 03:09:41

বিশ্বায়নের যুগে মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের অত্যাবশ্যকীয় হচ্ছে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য। আর এই দুধ উৎপাদনে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি দেশের প্রান্তিক খামারিদের নিয়ে ডেইরি শিল্পের উন্নয়নে ক্লাস্টার নেটওয়ার্কিংয়ের পথে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ সংস্থা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দেশের ৬১ জেলায় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশকে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দুধের মূল উৎস গরু। ৯০ শতাংশ দুধ আসে গরু থেকে, আট শতাংশ আসে ছাগল থেকে এবং দুই শতাংশ আসে মহিষ থেকে। ১৯৮৯-৯০ থেকে ২০০১-০২ অর্থবছর পর্যন্ত দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ২.৪ শতাংশ, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১৬.৪৪ শতাংশ। বর্তমানে মাথাপিছু দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ১৯৩.৩৮ মিলি লিটার।

ডেইরি শিল্পের উন্নয়নে ক্লাস্টার নেটওয়ার্ক তৈরিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো:-

খামারি নির্ধারণ ও প্রোডিউসার গ্রুপ গঠন

দেশে নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত মিলে ২ লাখ ৭০ হাজার টি ডেইরি খামার রয়েছে। এসব খামারিদের মধ্য থেকে খামারি ১ লাখ ১১ হাজার ৮০৯ জন (গাভীর মালিক ১ লাখ ৮ হাজার ৭৮ জন, মহিষের মালিক ৩৭৩১ জন) খামারিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব খামারিদের (২০-৪০ জন) একত্রিত করে বিভিন্ন ভ্যালু চেইনে ৩৩৯১টি প্রোডিউসার গ্রুপ বা পিজি গঠন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে (গাভী ৩২৬৬, মহিষ ১২৫টি)।

যারা সরাসরি প্রকল্পভুক্ত সুবিধাভোগী হবেন। পাবেন বিভিন্ন ভ্যালু চেইনে কারিগরি ও প্রণোদনা। পিজি সদস্যরা তাদের পিজির নিবন্ধন করাতে পারবেন। পারবেন নিজেদের চাঁদা ও পুঁজি গঠন করতে।

খামারের আধুনিকায়ন

দেশে সনাতন পদ্ধতিতে গবাগি পশু লালন পালনে বেশি খরচ হয়। একারণে খামারের আধুনিকায়নের দিকে জোর দেয়া হচ্ছে। এখন গ্রাম কিংবা শহর কোথাও খামারের মেঝে কাঁচা দেখা যায় না, ব্যবসার কথা বিবেচনা করে খামারের আধুনিকায়ন করা হচ্ছে, যে যার সামর্থ অনুযায়ী খামার আধুনিক করছে। এ আধুনিকায়নকে আরও এগিয়ে নিতে ৪৪ হাজার ক্ষুদ্র আদর্শ শেড নির্মাণে খামার ব্যবস্থাপনার জন্য খাদ্যপাত্র, পানির পাত্র, ফ্লোর ম্যাট, পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা করা হয়েছে। দেশের ৪৬৫টি উপজেলায় প্রযুক্তি নির্ভর প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হবে। যা দেখ খামারিরা তাদের খামারকে আধুনিকায়ন করতে পারবে।

ওষুধ ও চিকিৎসা

খামারের ঝুঁকি হ্রাসের জন্য এফএও এর সহযোগিতায় গবাদিপশুর নিরাপদ উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য কৃমিদমন কর্মসূচি, ক্ষুরারোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। এজন্যও পরিকল্পনা ও গাইড লাইন তৈরি করা হয়েছে। দেশের অনেক উপজেলায় বিনামূল্যে টিকাও সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রনয়ণ করা হয়েছে গবাদিপশুর জন্য হেলথ কার্ড। সকল পর্যায়ে প্রাণিস্বাস্থ্য নিরাপদ করার জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক(এমভিসি)। যা ব্যবহারে গবাদিপশুর চিকিৎসেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

ঘাস চাষ ও সংরক্ষণ

দেশের সকল খামারিদের বিনামূল্যে ঘাসের কাটিং সরবরাহ করার জন্য ৬১ জেলার ৪৬৬ উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস গ্রাউন্ডে উন্নত জাত ও বহুবর্ষজীবী ঘাসের নার্সারি করা হয়েছে। দেয়া হচ্ছে ঘাস চাষের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। বাণিজ্যিক ঘাস চাষেও সহায়তা দেয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে খাদ্য উৎপাদনে আগ্রহীদের ম্যাচিং গ্র্যান্টের আওতায় সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে যেন উৎপাদিত ঘাস নষ্ট না হয়, সেজন্য সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি পাইলটিং করা হবে। এখনও আমাদের দেশের খামারি হাউস হোল্ড ইন্ট্রিগেটেড, একারণে দানাদার ও কাঁচা খাদ্য তৈরি বা সংরক্ষণে উদ্যোক্তা তৈরি করা হচ্ছে।

খামারি প্রশিক্ষণ

দেশের ১ লাখ ১১ হাজার ৮০৯ জন ডেইরি খামারিদের প্রোডিউসার গ্রুপভিত্তিক বিভিন্ন ক্যাটারিতে প্রশিক্ষণ চলছে। পিজি সদস্যদের মধ্য থেকেই গড়ে তোলা হচ্ছে মাস্টার ট্রেইনার। যারা অন্য পিজি সদস্যদের সমস্যা সমাধান করতে পারবেন। দিতে পারবেন প্রয়োজনীয় পরামর্শ। পিজি সদস্যদের অধিকতর প্রশিক্ষণের জন্য এফএও এর গাইড লাইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ মডিউল বা কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে। দেশের ২৩৮টি উপজেলায় করা হয়েছে প্রশিক্ষণ সেন্টার। এছাড়াও করা হচ্ছে ফিল্ড স্কুল। যেখানে খামারিরা হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন।

ডেইরি খামার

জাত উন্নয়ন

খামারিদের ডেইরি গুণাগুণ সম্পন্ন দুধের গাভি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রজনন খামারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫০টি শতভাগ হলস্টেন ফ্রিজিয়ান বকনা সংগ্রহ করা হয়েছে। যেগুলো সাভারস্থ কেন্দ্রীয় গো- প্রজনন ও দুগ্ধ খামারসহ দেশের বিভিন্ন প্রজনন কেন্দ্রের কাছে বিতরণ করা হয়েছে।

সিমেন সংগ্রহ ও বিপনন

বাংলাদেশে মূলত ডেইরি উন্নয়নে সিমেন সংগ্রহ ও বিপণন করা হয়ে থাকে। তবে দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছর গড়ে ১ কোটির বেশি মাত্রার সিমেন উৎপাদিত হলেও বেসরকারিভাবে সিংহভাগ যোগান দেয়া হয়ে থাকে। সরকারিভাবে গড়ে ৪০-৪৫ লাখ সিমেন উৎপাদন ও বিতরণ করা হয়ে থাকে। সুষ্ঠুভাবে গাভিকে কৃত্রিম প্রজননের জন্য সারাদেশে সকল জেলা ও বিভাগীয় কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র সমৃদ্ধকরণ করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের দেয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ যাতে করে গাভিকে সফলভাবে কৃত্রিম প্রজনন করাতে পারেন।

দুধ কালেকশন সেন্টার ও ডেইরি হাব স্থাপন

দেশে উৎপাদিত দুধের ন্যায্য দাম ও দুধের পুষ্টিমাণ ঠিক রাখার জন্য মিল্ক কালেকশন সেন্টার ও ডেইরি হাব স্থাপন করা হবে। দেশে ২০টি ডেইরি হাব স্থাপন করা হবে। যার সঙ্গে যুক্ত থাকবে ২০টি করে মিল্ক কালেকশন সেন্টার। অবস্থানভেদে দুধেরমাণ ঠিক রাখার জন্য মিল্ক কালেকশন সেন্টারে যুক্তকরা হবে মিল্ক কুলিং সিস্টম।

জনসচেতনতা বৃদ্ধি

দেশের ৬১টি জেলায় দুধ ও দুগ্ধজাগ পণ্য গ্রহণের জন্য ভোক্তা বা গ্রাহক সৃষ্টি ও পুষ্টিবিষয়ক সচেতনতার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে রয়েছে ৩০০টি স্কুলে মিল্ক ফিডিং কার্যক্রম। মানসম্পন্ন ও নিরাপদ দুধ গ্রহণ ও পুষ্টিবিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুধ ও দুধের তৈরি পণ্য বিতরণ করা। এ জন্য এফএও কাজ করছে। এছাড়াও বিশ্ব দুগ্ধ দিবসে ডেইরি শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পুরস্কারও প্রবর্তন করা হয়েছে। বিতরণ করা হয়ে থাকে দুধের পুষ্টিগুণ বিষয়ক লিফলেট, পুস্তিকা, ব্যানার, ফেস্টুন, র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

মিনি ডায়াগনস্টিক ল্যাব স্থাপন

ভেটেরিনারি সেবার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য ৪৬৫টি উপজেলায় মিনি ডায়াগনস্টিক ল্যাব স্থাপন হবে। উপজেলা পর্যায়ে ডায়াগনস্টিক ল্যাবের যন্ত্রপাতির ব্যবহার বিধি ও ডায়াগনস্টিক কার্যক্রম নির্দেশিকা অনুযায়ী চলবে। এছাড়া ল্যাবের সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে বিভিন্ন উপজেলায় পাঠানো হয়েছে।

ফুড সেফটি কার্যক্রম পরিচালনা

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ, ভ্যালু চেইন পরিদর্শন এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ব্যবস্থা, বৃহৎ পরিসরে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইন সংশোধন ও বিধিমালা প্রনয়ন করা হবে। দুগ্ধজাতপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ডাটা বেইজ তৈরি, খাদ্যের মাণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা, স্টেকহোল্ডারদের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতি প্রদর্শন, খাদ্যের মাইক্রোবিয়াল, রাসায়নিক এবং নজরদারি, পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা হবে।

গুণগত মাণের পণ্য পাবে ভোক্তা

দেশে দুধ ও দুধের তৈরি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও প্রয়োজনীয় যোগান ও হাইজিন পণ্য না পাওয়া অনেকে ইচ্ছে থাকার পরেও গ্রহণ করতে পারছেন না। কিন্তু সরকার একই আম্ব্রেলার নিচে সকল সেবা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পারলে দুধ ও দুধের তৈরি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।বাড়বে দুধের উৎপাদন। সেদিন বেশি দূরে নয় যখন দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে।

ম্যাচিং গ্রান্ট

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের খামার থেকে শুরু করে পণ্য বাজারজাতকরণ পর্যন্ত নানাভাবে ম্যাচিং গ্রান্টের (প্রণোদনা) আওতায় যন্ত্রপাতি সরবরাহ কিংবা সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় পর্যায়ক্রমে ৪৬৫ জন ক্ষুদ্র খামারিকে খামার সহায়ক যন্ত্রপাতি ক্রয় সহায়তা করা হবে। এদের মধ্যে ৩০০ জনকে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত করণের আওতায় আনা হবে। যাদের মাধ্যমে দুধ পাস্তুরিত করা এবং সুগন্ধি দুধ, ঘি, দধি ইত্যাদি তৈরি করে বাজারজাত করা হবে। অবশিষ্ট ১৬৫ জন উদ্যোক্তা দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত করে মিষ্টিজাত খাদ্যপণ্য তৈরি করার কাজে ম্যাচিং গ্রান্টের সহায়তা পাবেন।

এছাড়াও দুগ্ধপণ্য বহুমূখীকরণে কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের এ অবস্থার উন্নয়নের জন্য পর্যায়ক্রমে ১০টি বড় আকারের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানকে মানসম্পন্ন দধি (ইয়োগার্ট) ও মজেরেলা পনির ইউনিট স্থাপনে ম্যাচিং গ্রান্টের আওতায় সহায়তা । দুধ দোহনের জন্য পরিবহনযোগ্য দুগ্ধ দোহন যন্ত্র সরবরাহ পাবেন। এ জন্য এক হাজারটি (৬০০টি একক ইউনিটের এবং ৪০০টি দ্বৈত ইউনিটের) দুগ্ধ দোহন মেশিন সরবরাহ করা হবে।

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমাদের দেশের ডেইরি সেক্টরের উন্নয়নে ক্লাস্টার নেটওয়ার্কিংয়ে যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যাতে করে দেশের প্রান্তিক খামারিরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য, নিজেরাই নিজেদের উন্নয়ন, খামার থেকে শুরু করে ভোক্তাদের কাছে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত যা যা করা প্রয়োজন তার প্রায় সবই এলডিডিপির পক্ষ থেকে করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, খামারিদের উন্নত ও গুণগতমানের পণ্য, প্রাণিখাদ্য উৎপাদনের জন্য সহায়ক যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে পণ্যে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের জন্যও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হবে।

গোলাম রব্বানী আরও বলেন, এলডিডিপির পক্ষ থেকে প্রান্তিক খামারিদের ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য উৎপাদনের জন্য ১৫০০টি ক্রিম সেপারেটর মেশিন বিতরণ করা, দ্রুত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন উপজেলায় মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক (এমভিসি) দেয়া হয়েছে।

এছাড়াও চিলিং মেশিন, দুধ দোহন যন্ত্র, ডেইরি বোর্ড গঠন, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল মিল্ক ফিডিং কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। কর্মপরিকল্পনা ইতিমধ্যে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। তবে নয়টি ক্যাটাগরিতে ম্যাচিং গ্রান্টের আওতায় খামারি ও উদ্যোক্তাদের বিশেষ সহায়তা প্রদানের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, দেশের উন্নয়নে ক্লাস্টার নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করে বলেন তারা প্রয়োজনীয় দুধ পান না। এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে তারা যে দামে দুধ সংগ্রহ করেন সেই দামে থামারীরা দুধ দিতে পারেন না। এ জন্য ক্ষুদ্র ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের খামারীদের একত্রিত করে একটি ইন্টারনেটওয়ার্ক সিস্টেম তৈরি হলে যে সব এলাকায় দুধ উৎপাদন কম সেসব এলাকায় দুধ পৌছে দেয়া যেতে পারে। এ জন্য সরকার গঠিত পিজিকে একটি করে ২-৩ হাজার লিটার দুধ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন চিলিং সেন্টার করে দিতে হবে। যাতে করে এখানে ৫-৭ ঘণ্টা দুধ সংরক্ষণ করা যায়। বিশেষ করে দেশের চরাঞ্চলের খামারীদের দুধ সংরক্ষণ ও পরিবহণের সমস্যা রয়েছে এসব অঞ্চলের খামারীদের মূল ধারায় নিয়ে আসতে হলে তাদের দিকেও নজর দিতে হবে। বিভিন্ন চিলিং সেন্টার থেকে দুধ সংগ্রহ করার জন্য ছোট ও বড় ধরণের গাড়ীর প্রয়োজন।

তিনি আরো বলেন, ক্লাস্টার করে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি করলেই হবে না এগুলো কনজিউম বা গ্রহণের ক্ষমতাও বাড়াতে হবে।নিরাপদ তরল দুধ পান এবং দুগ্ধজাত পণ্য ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য সরাকারি ভাবে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। তা না হলে ক্লাস্টারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না।

ডেইরি ফার্ম

জাকের ডেইরি ফার্মের স্বত্তাধিকারী অনোয়ার হোসেন বলেন, দেশের ক্ষুদ্র খামারিদের একত্রিত করে কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এটি সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা করা প্রয়োজন। শুধু ডেইরি সেক্টরের উন্নয়নে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন। যারা খামারিদের জন্য কাজ করবে। তাদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণেও কাজ করবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী খামারিদের ব্যবসায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

বিল্লাল ডেইরি এন্ড সুইটসের স্বত্তাধিকারী মো. ইউসুপ শামীম বলেন, তার খামারে ৫০টি দুধের গরু রয়েছে। তিনি প্রতিদিন ২৫০-৩০০ লিটার দুধ পান খামার থাকে। কিন্তু দেশের উন্নয়নে এই সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও এখনও এই সেক্টর অবহেলিত। দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের বাজারজাত ও ন্যয্যমূল্য পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। সরকারের এদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের খামারিরা জানান, ব্র্যাক, প্রাণ, আড়ং, আকিজ, মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে চাষিদের সমন্বিত করে দুধসংগ্রহ করে থাকে। এজন্য তারা খামারিদের নানান ধরনের সুযোগ সুবিধা, খাদ্য সরবরাহ, পরামর্শ দিয়ে থাকে। খামারিদের চুক্তি অনুযায়ী দুধ সরবরাহ করতে হয়। এক্ষেত্রে, খামারিরা দুধের দাম কম পান। দুধে ফ্যাট চেকিংয়ের নামে দাম কম দিয়ে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে অনেক খামারি ডেইরি খাত থেকে সরে গিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানে জরিত হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জে শাহজাদপুরের ব্র্যাকের দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, সকাল ও বিকাল দু সময়ে দুধ সংগ্রহ করে ব্র্যাক। এখানে দুধ দিতে হলে প্রথমে খামারিদের নিবন্ধিত হতে হয়। তারপরে দুধ দিতে পারেন। যে কেউ ইচ্ছে করলেই এখানে দুধ দিতে পারবে না। নিবন্ধিতরাই দুধ দিতে পারবেন। দুধ নিয়ে এলে সেন্টারে থাকা দায়িত্ব প্রাপ্তরা দুধের চর্বি পরীক্ষা করে দাম নির্ধারণ করে খাতায় লিখে রাখেন। নগদ কোনো টাকা দেয়া হয় না। টাকা জমা হয় তার ব্যাংক হিসাবে।

সিরাজগঞ্জের মিল্ক ভিটা ঘুরে জানা গেছে, তাদের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত প্লান্টে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ হাজার লিটার দুধ দরকার হয়। যার অধিকাংশই তাদের নিজস্ব দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিভাগ এবং ইন্ট্রেগ্রেটেড ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্কের কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহি উদ্দিন বলেন, দেশের ডেইরি খামারিদের একত্রিত করা খুব একটা সহজ নয়। খামারিদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরিতা বা দ্বন্দ্ব খুব বেশি। একারণে তার একত্রিত হতে চায় না। ফলে তারা একত্রে কোনো কাজে সফলতাও কম। সরকারিভাবে যদি একত্রিত হয়েও থাকে তা সুবিধা প্রদান পর্যন্তই হয়তো সীমাবদ্ধ থাকবে। সুবিধা শেষ হলেই তারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। এটি হচ্ছে বাস্তবতা। এ অবস্থান থেকে বের হতে না পারলে ডেইরি শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

তিনি তার গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, তিনি দেখেছেন খামারিদের শুধুমাত্র ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। খামারিদের খামারভিত্তিক নলেজ অর্জনে কাজ করতে হবে। যাতে করে তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। মোদ্দা কথা হলো, খামারিদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে খামারের অবস্থা বুঝে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, এই সেক্টরের উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায় হলো তথ্য জানা বা জানানো সংক্রান্ত জটিলতা। সরকারি কিছু পলিসিগত সমস্যাও এজন্য দায়ী। সরকার কাউকে বাধ্য করতে পারে না তথ্য দিতে। একারণে সঠিক তথ্য না পাওয়ায়ও সমস্যা প্রকট হচ্ছে। সরকার আমদানিনির্ভর খাদ্যমূল্য কমানোর নানা উদ্যোগ নিলেও এর সুফল পায় না খামারিরা, কারণ সরকার আমদানিকারকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দীন মনে করেন, সরকার ডেইরি সেক্টরের উন্নয়নে এলডিডিপির মাধ্যমে যে প্রোডিউসার গ্রুপ ( পিজি) গঠন করেছে যা প্রকল্প চলাকালীন সময়ে ভালো ভাবে চলবে। কিন্তু প্রকল্প মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে পিজিগুলো আনিশ্চয়তার মধ্যে পরতে পারে। সরকারকে এবিষয়ে নানা উদ্যোগ নিলেও প্রকল্প শেষ হলেও পিজিগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তবেই কাঙ্ক্ষিত অর্জন সম্ভব হবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ২৯.৫ লাখ মোট্রিক টন। একইভাবে ২০১১-১২অর্থবছরে ৩৪.৬, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫০.৭, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬০.৯, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৯.৭, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭২.৭৫ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯২.৮৩, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৪.১, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯৯.২৩, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০৬.৮, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৯.৮৫ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ১৩০.৭৪ লাখ মে.ট্রিক টন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যনুযায়ী দেশে দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২২ সালে ১৫৪. ৯ লাখ মে. টন, চাহিদা ধরা ছিল প্রতি জনে প্রতিদিন ২৫০ মিলি লিটার, অনুরূপ ২০৩০ সালে যথাক্রমে ১৯৬.৭ লাখ মে.টন চাহিদার বিপরীতে প্রতি জনে প্রতিদিন ২৭০ মিলি লিটার ২০৪১ সালে ২৪৪.৭ লাখ মে.টন চাহিদার বিপরীতে প্রতি জনে প্রতিদিন ৩০০ মিলি লিটার দুধের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে।

দুধের অপরিহার্য উপাদান ল্যাকটোজ, যা দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বৃদ্ধিতে সহায়ক। মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার মূল উপাদান দুধ। বাংলাদেশের জনগণের একটি বৃহৎ অংশ তরল দুধ পান থেকে বঞ্চিত। গরুর দুধে আছে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিংক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম। গরুর দুধের কম্পজিশনে পানি ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ল্যাকটোজ ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, ফ্যাট ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রোটিন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর