খেজুরের মূল্যবৃদ্ধিতে একে অন্যকে দোষারোপ

, জাতীয়

মো. রাকিব হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-02-28 11:58:31

সারাদিন রোজা পালন শেষে খেজুর খেয়ে ইফতার শুরু করতে চান রোজাদার। তাই প্রতি বছর রমজান মাস এলেই খেজুরের দাম বাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বাড়ার পেছনে মূল কারণ অতিরিক্ত ডিউটি (শুল্ক) ফি এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের অতি-মুনাফার লোভ। আর খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বেশি দামে কিনতে হয় বলেই, বিক্রি বেশি দামে করতে হয়।

মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বাদামতলীর পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রকারভেদে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে খেজুর। বাজারে সবচেয়ে কম দামে ১৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে জিহাদি খেজুর। আর সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে মেডজল; ১০০০-১৪০০ টাকা কেজি।

মেসার্স আল্লাহওয়ালা এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার বিপ্লব জানান, বর্তমানে জিহাদি খেজুরের একটি বস্তা (৩৫-৩৬ কেজি) প্রতিকেজি ১৫৬ টাকা দরে ৫৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে একটু নিম্নমানের হলে তা ৪৪০০ থেকে ৪৮০০ টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে। মাসরুক জাতের খেজুর ৪৪০ টাকা দরে (৫ কেজির বক্স) ২২০০ টাকা। এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় মেডজল জাতের খেজুর বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০০০ থেকে ১৪০০ টাকা। পাঁচ কেজির একটি বক্স বিক্রি হচ্ছে ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকায়।

এর বাইরে জয়তুন গ্যালাক্সি ১৫৫ টাকা কেজি (৩০ কেজির বস্তা), বারনী ৩২০ টাকা করে (১০ কেজির বক্স) ৩২০০, দাবাস ক্রাউন ৪৬০ প্রতি কেজি (১০ কেজির বক্স ৪৬০০ টাকা), দাবাস নরমাল ৩৭০ টাকা করে (১০ কেজির বক্স) ৩৭০০ টাকা, মাবরুর জাতের খেজুর ৯০০-৯৫০ টাকা কেজি দরে (৫ কেজির বক্স) ৪৫০০-৪৮০০ টাকা, মাসরুর ৩২০ করে (৫ কেজির বক্স) ১৬০০ টাকা এবং মাজদূর ৫২০ করে ৫ কেজির বক্স বিক্রি হচ্ছে ২৬০০ টাকায়।

বিপ্লব বলেন, আমরা প্রতি কেজি খেজুরে ৫০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ এক টাকা পর্যন্ত লাভ করতে পারি। এর বেশি লাভ করার সুযোগ নাই। রমজান মাস এলে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অতি-মুনাফার যে অভিযোগ আসে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। মূলত খুচরা ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ এক কেজি খেজুরে কমপক্ষে ১০০ টাকা থেকে ৩০০/৪০০ টাকা পর্যন্ত লাভ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ ন্যায্যমূল্যে খেজুর খেতে পারছে না। এছাড়া সরকারি ভ্যাট ট্যাক্স ডিউটি ফির কারণে খেজুরের দাম বেশি।

বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে প্রশ্ন করলে মেসার্স নাবিল এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার আব্দুর রব বলেন, এক গাড়ি খেজুর ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করে ২৫ হাজার টাকাও লাভ হয়নি। তাহলে বাজারে সিন্ডিকেট করল কীভাবে। তার দাবি, খেজুর ব্যবসায় কোন সিন্ডিকেট নাই। তবে সরকার যে ভ্যাট ১৫ শতাংশ কমানোর কথা তার কোন প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে না। সময়মতো ভ্যাট না কমালে দাম কমানো সম্ভব নয়। তাছাড়া বর্তমানে যে খেজুর বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তা গত বছরের অর্ডার করে জানুয়ারি মাসে দেশে আসছে। একটা অর্ডার দিলে তা আসতে অন্তত তিন মাস সময় লাগে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ফলমূলের বাজার বাদামতলীতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে যে কয়জন ব্যবসায়ী খেজুর আমদানি করেন তাদের মধ্যে অন্যতম সাবেক সংসদ সদস্য হাজী সেলিম (মদিনা গ্রুপ), সিরাজ হাজী (সাথী এন্টারপ্রাইজ), মো. আল আমিন (শিফা এন্টারপ্রাইজ), সবুজ মিয়া (এস.কে ট্রেডার্স), মো. হুমায়ন হাজী (বন্ধু এন্টারপ্রাইজ), আলমগীর মিয়া (আনিকা এন্টারপ্রাইজ), মো. আক্তার (মারিয়া এন্টারপ্রাইজ), রাসেল আহমেদ (দেশ-বিদেশ এন্টারপ্রাইজ), মো. সাইদুর রহমান (জননী এন্টারপ্রাইজ), মো. কাইয়ুম খান টুটুল (টুটুল এন্টারপ্রাইজ)-সহ আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান।

খেজুর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সাথী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. সিরাজ হাজীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে তারা খেজুর ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত। তার দাবি, বর্তমান ডলারের রেট অনুযায়ী অনেকটা লসে বিক্রি করতে হচ্ছে খেজুর। তার প্রতিষ্ঠানে মূল্য তালিকা প্রদর্শন করা আছে। সেখানে দেখা যায় আজকের বাজার দর অনুযায়ী, প্রকারভেদে দাবাস ১০ কেজি ৩৭০০ টাকা, দাবাস ৫ কেজি ২০০০, দাবাস (সিআর) ১০ কেজি ৪৫০০, দাবাস চিপস ৪২০০, লুলু চিপস ৪২০০, বারনী (প্রিমিয়াম) ১০ কেজি ৩০০০, বারনী (নরমাল) ১০ কেজি ২৯০০, খালাস ১০ কেজি ৩৩৫০, নাগাল ১০ কেজি ৩১৫০, ছায়ের ১০ কেজি ২৯৫০, জিহাদি ১০ কেজি ২৫৫০ এবং রেজিজ ১০ কেজি ৩২০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।

দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিগত কয়েক রমজানে খেজুরের দাম কম ছিল। দাম বাড়ানোর পেছনে ব্যবসায়ীদের দোষ দিলে চলবে না। আপনারা গিয়ে এনবিআরকে জিজ্ঞেস করেন, কাস্টমসকে জিজ্ঞেস করেন। এক কেজি খেজুর কেনা ১১০ টাকা কিন্তু ২১০ টাকা কেন ডিউটি ফি দিতে হয়? এর উত্তর কে দেবে। দামটা বাড়ে কোথা থেকে। শুধু টেলিভিশনে বসে আর সেমিনার টকশো করে তো দাম কমানো সম্ভব না। ভ্যাট-ট্যাক্স ডিউটি ফি কত হিসাব আছে? আমরা তো লসে বেচতেছি। যারা দাম বৃদ্ধি নিয়ে বড় বড় কথা বলে তাদের একদিন দেন, ব্যবসা করতে দেখেন- তারা কী করে!

অতিরিক্ত মুনাফার অভিযোগের বিষয়ে খুচরা খেজুর ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, পাইকারদের কাছ থেকে আমরা যে খেজুর আনি তাতে দশ কেজি খেজুরের মধ্যে তিন কেজি থাকে নরম, গলা। কখনো কখনো অর্ধেকের বেশি নষ্ট খেজুর থাকে। মাপেও অনেক সময় কম থাকে। তাছাড়া গাড়ি ভাড়া আছে। দোকান খরচ, কর্মচারী খরচ। সব খরচ বাদ দিয়ে তারপর লাভ করতে হয়। এতো হিসাব করেও মাঝেমধ্যে খালি হাতে বাসায় ফিরতে হয়।

তিনি বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা গড় পড়তায় সব খেজুর একসঙ্গে বিক্রি করে। গতবারের কেনা খেজুর এই বছর বিক্রি করে। তাও তারা বলে লাভ নাকি করে না।

অতিরিক্ত মুনাফার অভিযোগ নাকচ করে আল- আমিন নামে এক খেজুর ব্যবসায়ী বলেন, রমজানে খেজুরের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে দায়ী মূলত পাইকারি ব্যবসায়ীরা। কারণ গতবারের খেজুর এই বছর বিক্রি করলে দাম রাখছে বর্তমান মূল্যে। যে কারণে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর