হাঁস পালনে বদলে গেছে ভরসার দুঃখময় জীবনগল্প

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, রংপুর | 2023-12-21 20:12:10

রংপুর সদর উপজেলার হরিদেবপুর ইউনিয়নের ভরসা মিয়া। যাকে গ্রামের সবাই হাঁস ভরসা নামেই চিনেন। প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পার হতে না পারলেও তিনি দারিদ্রতার কষাঘাত পেরিয়েছেন। হাঁস প্রতিপালনে বদলে গেছে ভরসার দুঃখময় জীবনগল্প। ফকিরান দেরহালিয়া গ্রামের আত্মপ্রত্যয়ী হাঁস খামারি হিসেবে সাড়া ফেলেছেন এ যুবক।

 

ভাঙারির ফেরি ব্যবসার সামান্য আয়ে ভরসার সংসার যখন বেসামাল। তখনই স্থানীয় ঈমাম ইদ্রিস আলী ও গোবিন্দগঞ্জের খামারী বন্ধু মন্টু মিয়ার পরামর্শে ৫০০টি হাঁস দিয়ে শুরু হয় ভরসার হাঁসের খামার। প্রথম দফায় সাফল্য;  লাভের মুখ দেখার পর তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

২০১২ সালে মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকায় শুরু হয় ভরসা মিয়ার হাঁস পালনের গল্প। এসময় পরামর্শ দাতাদের সহযোগিতায় কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই হাঁস প্রতিপালনে ঝুঁকে পড়েন তিনি। দিনের দিনের পর তার খামারে বাড়তে থাকে হাঁসের সংখ্যা। বছরের পর বছর বাড়ে বার্ষিক আয়ও। বর্তমানে হাঁসের খামারের পাশাপাশি পাঁচটি গরু দিয়ে শুরু হয়েছে গরুর খামার।

হাঁস প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে এভাবেই সাফল্যের সিঁড়ি খুঁজে পান আটত্রিশ বছর বয়সী ভরসা মিয়া। শুধু যুবকরাই নন, এমন ঈর্ষনীয় সাফল্যের জন্য ভরসার এই হাঁস-খামার দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন নানা বয়সী বেকার মানুষ। অনেকেই উৎসাহিত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন ভরসার মত খামার গড়ার প্রত্যয় নিয়ে।

৫০ হাজার টাকায় শুরু করা ৫০০ হাঁসের খামার থেকে পরিশ্রম আর একাগ্রতাই হাঁসের পাশাপাশি ভরসা আজ গরুর খামারে উন্নতি করেছে। খাঁটি ক্যাম্বেল, জিংডিং ও মাংসের জন্য বিদেশি বেলজিং প্রজাতির হাঁস রয়েছে তাঁর খামারে। এরমধ্যে এপ্রিল থেকে আগস্ট এবং অক্টোবর থেকে  ডিসেম্বর এ দুই মৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে হাঁস প্রতিপালন করেন ভরসা।

এছাড়া ডিমের জন্য ২৫০ থেকে ৩০০ হাঁস আলাদাভাবে খামারে রয়েছে। অক্টোবর মৌসুমে হাঁসের উৎপাদন কম থাকায় এসময় বেশি দামে হাঁস বিক্রি করে মুনাফা পেয়ে থাকেন। ২৫ টাকা থেকে ৪৫ টাকা দরে তিন প্রজাতির বাচ্চা হাঁস সংগ্রহ করে দুই মৌসুমে সেগুলো প্রতিপালন করে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। এতে প্রতিটি হাঁসে একশ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। এখন সংসার ও সন্তানের লেখাপড়ার খরচ বাদে হাঁসের খামার থেকে প্রতিমাসে ভরসার আয় হচ্ছে প্রায় বারো হাজার টাকা। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ প্রচেষ্টা এবং পরিশ্রমের কারণে হাঁসের পাশাপাশি গরুর খামারে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে পরিবারটি।

এদিকে হাঁসের খামারে ভরসার বদলে যাওয়া সাড়া ফেলেছে হরিদেবপুরের ফকিরান দেরহালিয়া গ্রামে। ভরসাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ গ্রামের নুর আলম, মোরসালিন, হারুন মিয়া, আয়নাল হকসহ অন্তত দশ জন এখন হাঁসের খামার গড়েছেন। তাঁদেরও অনেকেই এখন স্বাবলম্বী।

এক সময়ের গরু ব্যবসায়ী বৃদ্ধ আব্দুল মালেক মিয়ার ছেলে ভরসা মিয়া। ছয় সন্তানের মধ্যে ভরসা পরিবারের দ্বিতীয় ছেলে। ভরসা বাদে বাকি তিন ছেলে কৃষিকাজ, কোর্টের মহুরী ও গরু ব্যবসা করেন। আর ভাঙারি ব্যবসায় সংসারে হতাশা নেমে আসা ভরসা এখন সফল হাঁস খামারী। স্ত্রী ও দুই মেয়ে সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই আছেন ভরসা মিয়া।

ভরসার এলাকার গ্রামবাসী চান্দু মিয়া ও হাবিব জানান, প্রত্যেক দিনই ভরসা হাঁসের পাল নিয়ে মাঠে আসে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁস নিয়ে পড়ে থাকেন। সন্ধ্যা হলে ভরসা সাথে সাথে হাঁসগুলো সারিবদ্ধভাবে খামারের দিকে যায়। এদৃশ্য দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসে এবং ভরসার সাফল্যের কথা শুনে ফিরে যায়।

এ ব্যাপারে ভরসা মিয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, সরকারি কোন সহায়তা পাইনি। যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণও নেয়ার সুযোগ হয়নি। তারপরও মনোবল ও সাহস ছিল। সাফল্যের পেছনে নিজের উদ্যম আর পরিশ্রমসহ এলাকার ইদ্রিস আলী ঈমাম, বন্ধু মন্টু মিয়া এবং পরিবারের সদস্যদের উৎসাহ সহযোগিতা রয়েছে।

তিনি বলেন, বেকার যুবক যারা, কর্মসংস্থানে সুযোগ না পেয়ে হতাশ, তাদের উচিত পশুপাখি পালন করা। খামার গড়ে তোলা। এতে ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভব। এসময় ঋণ পরিশোধ এবং খামার সম্প্রসারণে সরকারি সহায়তার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

ভরসা মিয়া চাইলে তাকে সহযোগিতা করা হবে এমন আশ্বাসের কথা জানান জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে মানুষ সফল হতে পারে তার দৃষ্টান্ত ভরসা মিয়া। ভরসার মত আরও কোনো যুবক যদি এরকমভাবে এগিয়ে আসে তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।

এ সম্পর্কিত আরও খবর