ব্ল্যাকে টিকিট কিনে বিপাকে ১৩ যাত্রী, কালোবাজারির নাম 'জসিম'

, জাতীয়

মাসুম বিল্লাহ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, গাইবান্ধা | 2024-04-27 11:47:00

বুড়িমারী (লালমনিরহাট) থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন বুড়িমারী এক্সপ্রেস। এই ট্রেনে দ্বিগুণ দামে ঢাকার টিকিট কিনেও যাত্রীদের পড়তে হয়েছে চরম বিপাকে। হাতে টিকিট থাকা সত্বেও কর্তৃপক্ষের কাছে সাভ্যস্ত হতে হয়েছে বিনা টিকিটের অবৈধ যাত্রী হিসেবে। শুধু কি তাই? সিনেমার মতো যেন অভিনয় দেখতে থাকেন ট্রেনের অন্য যাত্রীরা। আর দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা পালন করে ক্যামেরাম্যান এবং সাংবাদিকের ভূমিকা।

মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) রাতে এমনই হতাশাজনক এক ঘটনা ঘটেছে ‘বুড়িমারী এক্সপ্রেসে'। যাত্রীরা দ্বিগুণ মূল্য দিয়ে টিকিট কিনেও পড়তে হয়েছে তোপের মুখে। এদিন ট্রেন সংশ্লিষ্টদের প্রশ্নের কোনও সদত্তোর দিতে পারেনি পাঁচ টিকিটে থাকা ‘ঞ’ বগীর ১৩ যাত্রী। তাদের মধ্যে দুই সন্তানসহ যেন দুমরে-মুচরে গেছেন এক নারীও। কারণ তাদের টিকিটগুলো ছিল ব্ল্যাকে ক্রয় করা।

কিভাবে পেয়েছেন এসব টিকিট?  এমন প্রশ্নের উত্তরে যাত্রীদের মুখে ছিল একটিই নাম 'জসিম'। প্রশ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রেতা কে এই জসিম?

এদিন বুড়িমারী এক্সপ্রেসে নাটোর যাচ্ছিলেন বার্তা২৪.কমের গাইবান্ধার এই প্রতিবেদক। তিনি গাইবান্ধা রেল স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠেন। এদিন বুড়িমারী এক্সপ্রেস রাত ১০ টা ৫৬ মিনিটে গাইবান্ধা রেল স্টেশন থেকে ছেড়ে গিয়ে বোনারপাড়া স্টেশনে প্রবেশ করে রাত ১১টা ২০ মিনিটের দিকে। সেখান থেকে ‘ঞ’ বগিতে বেশ কিছু যাত্রী ওঠেন। ট্রেনে উঠেই এক নারী যাত্রীসহ চারজন যাত্রীর মধ্যে আসনে বসা নিয়ে বিবাদ বাধে। কারণ তাদের হাতে থাকা টিকিটের প্রত্যেকটি টিকিটই ছিল একই আসন নম্বর। মূলত কোনটা কার আসন সেটিই নিয়েই বিবাদের শুরু হয়। পরে উপস্থিত যাত্রীদের সহায়তায় বিষয়টির সমাধান হয় এবং ঞ- ৫, ৬, ৭ ও ১১ নম্বর আসনে বসেন বিবাদে ওই নারীসহ জড়ানো যাত্রীরা।

বিবাদ হওয়া চার যাত্রীর কাছে থাকা টিকিটে দেখা যায়, টিকিট দুটি ১৩ এপ্রিল একই তারিখে ক্রয় করা। যার একটিতে ঞ-৫,৬,৭, ও ১১ এই চারটি আসন এবং নারীর হাতের অপর টিকিটেও রয়েছে ঞ-৫ ও ৭ ও ১১ আসন নম্বর। ওই টিকিটে যাত্রীরা বোনারপাড়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত যাত্রা করবেন।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়; 

এদিন রাত ১ টার দিকে বুড়িমারী এক্সপ্রেস যখন সান্তাহার-নাটোর স্টেশনের মাঝামাঝিতে তখন ট্রেনের এই ‘ঞ’ বগিতে আসেন টিকিট কালেক্টর 'টিটিই' গোলাম হাফিজ রিজু। এসময় টিকিট চেক করার এক পর্যায়ে বিতর্কিত এই দুটি টিকিটসহ একই ধরণের আর পাঁচটি টিকিট দেখতে পান তিনি। যা দেখে ওই সব টিকিটের যাত্রীদের সাথে চটে যান টিকিট কালেক্টর। রাগান্বিত হয়ে কোথায় আর কার কাছ থেকে কেনা হয়েছে এসব টিকিট এমন প্রশ্নে দুই সন্তানসহ ঢাকাগামী এক নারী ছাড়া যাত্রী ১১ যাত্রীই বলেন একটিই নাম জসিম। তারা বোনারপাড়ার জসিমের থেকে দ্বিগুণ দামে ক্রয় করেছেন এসব টিকিট। এসময় টিটিই'র সাথে থাকা পুলিশ সদস্য তাদের ছবি ও কথা ভিডিও রেকর্ড করতে থাকেন। এদিন শত আপত্তি সত্ত্বেও ওই নারীরও ভিডিও বক্তব্য রেকর্ড করেন দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্য। এ সময় ওই নারী চরম বিব্রতবোধ করে কাপড়ে ভিতরে মুখ লুকানোর চেষ্টা করেন।

এদিনের ব্ল্যাকে ক্রয় করা টিকিটগুলো বিশ্লেষন করে দেখা যায়, একই তারিখে ক্রয় করা ওই সব টিকিটে আসন সংখ্যা ছিল ১৩ টি। যার দুটি টিকিট ৮ যাত্রী, একটিতে ২ যাত্রী এবং অপর দুটি টিকিটে আসন সংখ্যা ৭ টি দেওয়া থাকলেও যাত্রী ৩ জন। টিকিট ক্রয়ে যে এনআইডি, মোবাইল নম্বর, এবং যাদের নামে ক্রয় করা হয়েছে তাদেরকে যাত্রীদের কেউই চেনেন না। শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে পাঁচ যাত্রীর কেউ কাউকেই চেনেন না!

১৩ যাত্রীর হাতে থাকা পাঁচ টিকিটের একটিতে দেখা যায়, ১৩ এপ্রিল তারিখে ক্রয় করা। ক্রয়কারীর নাম মো.আব্দুর রাজ্জাক বেরারি। টিকিটে এনআইডি নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে ৮৬৭...৬৮৪ এবং মোবাইল নম্বর ০১৩০......৬৩৩ ।

এছাড়া আরেকটি টিকিটে দেখা যায় টিকিট ক্রয় কারীর নাম হাওয়া আকতার হাসি। যেখানে এনআইডি নম্বর ৩৩১...৩৭৯, আর মোবাই নম্বর ব্যবহার হয়েছে ০১৭০...৫৮১। 

ওইসব টিকিটে যাত্রীদের মধ্যে একজন শাহিন (৫৫)। তার বাড়ি বোনারপাড়ায়। তিনি ফার্নিচারের ব্যবসা করেন, জরুরী কাজে ঢাকায় যাচ্ছেন তিনি। তার কাছে থাকা টিকিটের আসন নম্বর ঞ-৫, ৬, ৭ ও ১১। টিকিট দেওয়ার সময় তাকে বলা হয়েছে তার আসন নম্বর ঞ-৭। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে অপর তিনটি আসন কার? এছাড়া তার এই টিকিটে ক্রয়কারীর নাম দেখাচ্ছে আব্দুর রাজ্জাক বেরারি।

এ সময় জানতে চাইলে যাত্রী শাহিন বলেন, ‘কয়েকদিন চেষ্টা করেও টিকিট পাইনি। পরে জসিমের থেকে বাধ্য হয়ে দ্বিগুণ দামে টিকিট কিনেছি। কিছু করার নাই সবখানেই একই অবস্থা। যেতে হবে তো!’

আপনার হাতের টিকিটে আব্দুর রাজ্জাক কে? এনআইডি আর এই মোবাইল নম্বরইবা কার? এমন প্রশ্নের যাত্রীর সরল উত্তর, মোবাইল নম্বর এবং এনআইডি আর আব্দুর রাজ্জাক কে আমি জানিনা।

এছাড়া যাত্রীদের মধ্যে ওই নারীর বাড়ি সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়ার শিমুলতাইর গ্রামে। মেয়ে মাহমুদা (১১) ও ছেলে মামুন (৬) কে সাথে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন তিনি। তার হাতের টিকিটে আসন নম্বর ছিল ঞ-৫, ৭, ও ১১ নম্বর। ওই নারীর দাবি তাকে বলা হয়েছে তার আসন নম্বর ৫ ও ৭। তাহলে কোচের ১১ নম্বর আসনের যাত্রী কে?

এ সময় জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, ঢাকা যাওয়ার জন্য আমার স্বামী দুটি টিকিট ১৭০০ টাকা দিয়ে কিনেছে। স্টেশন থেকে নয়। তবে, কার থেকে কিনেছে তা জানা নেই ওই নারীর। তিনি বলেন, টিকিট থাকার পরেও এমন ঘটনা খুব কষ্টের। এসময় পুলিশের নেওয়া ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দিবে কি না-এমন প্রশ্ন করে আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন তিনি।

ব্লাকে টিকিট ক্রয় করা আরেক যাত্রীর নাম শাকিল (২৩) । তবে, শাকিলের কাছে একটি নয় রয়েছে দুটি টিকিট। ওই দুই টিকিটের ৮টি আসনে ঢাকা যাচ্ছেন তারা আট যুবক।

শাকিলের হাতে থাকা দুটি টিকিটই কাউন্টার থেকে প্রিন্ট করা। যার মধ্যে ১, ৪,২৮ ও ৩০ নম্বরের ৪ টি আসনের একটি টিকিটে যাত্রীর নাম দেখাচ্ছে হাওয়া বেগম।  

হাওয়া বেগম কে? শাকিলের কাছে টিটিই'র এমন প্রশ্নে শাকিল বলেন, চিনিনা। তাহলে তার নামের টিকিটটি তোমার হাতে এলো কিভাবে? শাকিল বলেন, বোনারপাড়ার জসিম ভাইয়ের থেকে প্রতিটি টিকিট ৮০০ টাকা করে কিনেছি। এসময় জসিমের নাম শুনে ক্ষিপ্ত হন টিটিই। এসময় টিটিই সহ ট্রেন সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি এসব কালোবাজারিতে টিকিট ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে বোনারপাড়া স্টেশনের বর্তমান স্টেশন মাস্টার খলিলও জড়িত আছে বলে অভিযোগ তোলেন।

এ সময় জানতে চাইলে টিকিট কালেক্টর গোলাম হাফিজ রিজু বার্ত২৪.কমকে বলেন, এই ঞ বগীর পাঁচটি টিকিটে থাকা ১৩ যাত্রীর প্রত্যেকেই ব্ল্যাকে টিকিট কিনেছেন। বিধি মোতাবেক তারা প্রত্যকেই অবৈধ যাত্রী। কেননা, তাদের কাছে থাকা টিকিট ক্রয়ে যে এনআইডি ব্যবহার করা হয়েছে সেই নামের বা সেই এনআইডিধারীর সাথে যাত্রীদের কোন মিল নেই । তাদের সবগুলো টিকিট ব্ল্যাকে পাওয়া। নিয়ম অনুযায়ী এসব যাত্রীদের এখন জরিমানাসহ টিকিট ক্রয় করতে হবে। যদিও তিনি তা করেন নি।

কে এই জসিম?

সেদিনের একটি বগীর ১৩ যাত্রীর কাছে ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রেতা কে এই জসিম? তার পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করেছেন বার্তা২৪.কমের গাইবান্ধার এই প্রতিবেদক। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে-

সাঘাটা উপজেলার রাঘবপুর গ্রামের বীর মুক্তযোদ্ধা মৃত হায়দার আলীর ছেলে 'জসিম'। তিনি এক সময় বোনারপাড়া স্টেশনে ব্যবসা করতেন। জসিম ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর টিকিট কালোবাজারে বিক্রির সময় বোনারপাড়া থেকে তাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে বোনারপাড়া রেলওয়ে পুলিশ। সে সময় তার (জসিম) কাছ থেকে ট্রেনের চারটি টিকিট উদ্ধার করা হয়। পরে একই তারিখে রেলওয়ে পুলিশ বাদি হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে তাকে কারাগার পাঠানো হয়। যার মামলা নম্বর-২। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত জসিম মুঠোফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, "এখন টিকিট সব অনলাইনে, আর টিকিটে আমার নাম বা আমার নম্বর (এনআইডি-মোবাইল) নাই। বোনারপাড়াতে মানুষকে ভালবেসে কিছু করতে যায়া (গিয়ে) আমার নামে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তারপর থেকে আমি অনেকটাই দূরে।

এ সময় তিনি বলেন, বোনারপাড়া স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে সবাই এই ব্যবসার সাথে জড়িত। মূলত তারাই এসব টিকিট বিক্রি করে যদি কোনো সমেস্যা হয়, তারা আমার (জসিম) নামটা তাদেরকে বলতে বলে দেয়।

এ সময় তিনি আরো বলেন, ট্রেনে সেদিনের ঘটনা আমি শুনেছি, যাত্রীরা নাকি আমার নাম বলেছে। আপনিও নাকি সেদিন ট্রেনে ছিলেন আমি জানি।

বোনারপাড়া রেলওয়ে ষ্টেশনের ষ্টেশন মাস্টার খলিল মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, টিকিট কালোবাজরীর বিষয়টি দেখার দায়িত্ব জিআরপি এবং আরএমপি পুলিশের। তারা কী করে? টিকিট এখন শতভাগ অনলাইনে। যদি কেউ আমার কথা বলে থাকে তা মিথ্যা বলেছে। আমি জসিমকে সেরকমভাবে চিনিওনা। 

এ ব্যাপারে গাইবান্ধা রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম মুঠোফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন,' অভিযুক্ত জসিমকে ২০১৯ সালে কালোবাজারে টিকিট বিক্রিকালে হাতেনাতে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় রেলওয়ে পুলিশ। এই অভিযোগের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। 

এ বিষয়ে ডিভিশনাল ট্রাফিক সুপারিনটেনডেন্ট (লালমনিরহাট) আব্দুল্লাহ আল মামুন মুঠোফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করতে শতভাগ টিকিট এখন অনলাইনে।

তিনি বলেন, অনেক সময় সিন্টিকিটেরা এক সিটের টিকিট একাধিক ব্যক্তিকে দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে ট্রেনে থাকা সংশ্লিষ্টরা যাদের টিকিটের সাথে নাম বা এনআইডির মিল পায় তাদেরকে ওই সীটে বসিয়ে দেয় এবং অন্যজনকে জরিমানাসহ নতুন টিকিট করে দেওয়া হয়।

তবে, ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইন করা সত্ত্বেও এখনো শতভাগ কালোবাজারী নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি স্বীকার করে তিনি বলেন, একজন কৃষক যখন কোনো দোকানে টিকিট নিতে যান, আর সেই দোকানদার যদি সিন্ডিকেট হয় তাহলে তার আইডি দিয়েই ওরা চারটি টিকিট ক্রয় করে বেশি দামে বিক্রি করে থাকে।

এ সময় ষ্টেশনের আশেপাশে টিকিট কালোবাজারী থাকার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ষ্টেশনের আশেপাশে চিপায়-চাপায় ট্রেনের টিকিট কালোবাজারীর একটি সিন্ডিকেট আছে। যারা টিকিট কেনে তারাও বিষয়টি জানেন। বিষয়টি একটি ফৌজদারী অপরাধ।

এ ব্যাপারে সৈয়দপুর রেলওয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) ফারহাত আহমেদ মুঠোফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বিষয়টি জানলাম; অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পুলিশ কালোবাজারী নির্মূলে শতভাগ চেষ্টা করছে, তৎপর রয়েছে। টিকিট সিন্ডিকেট ধরতে রেলওয়ে পুলিশের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।’

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর