তাপদাহ থেকে বাঁচতে ঢাকার সবুজায়নে প্রয়োজন সমন্বিত বৃক্ষরোপণ

, জাতীয়

সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-04-27 12:54:16

বৈশাখের শুরু থেকেই রুক্ষ-শুষ্ক হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। বেড়েই চলেছে সূর্যের তেজ। অবিরাম তাপপ্রবাহে ঢাকার জনজীবনে যখন হাঁসফাঁস অবস্থা; তখন ঢাকায় সবুজের গুরুত্ব অনুভূত হচ্ছে।

নগর বনায়ণ বিশেষজ্ঞরা  বলছেন, রাজধানী ঢাকাকে অপরিকল্পিতভাবে ‘অতি নগরায়ণ’ করতে গিয়ে নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে তারা বলছেন, বৃক্ষরোপণের জন্য একটি বিজ্ঞান-ভিত্তিক সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন। যা দীর্ঘদিন ধরে নগর কর্তৃপক্ষের কাছে অবহেলিত। তার ফলাফল এখন সবার কাছে স্পষ্ট— ব্যাপক বক্ষরোপণ সত্ত্বেও ঢাকাকে সবুজায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে নগর বনায়নের জন্য ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় জায়গার প্রকট সংকট রয়েছে।

চলমান তাপপ্রবাহে অনেকেই বড় পরিসরে বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরুর জন্য চাপ দিচ্ছে। তবে বৃক্ষরোপণ করলেই হবে না তার ‘সঠিক পরিচর্যাও’ হওয়া উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘বৃক্ষরোপণের পর চারা গাছ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম পানি দেওয়া এবং পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। যদি গ্রীষ্মের এমন তাপে গাছ রোপণ করি তবে বর্ষা পর্যন্ত সঠিক পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে।’

‘কিন্তু, বাস্তবতা হলো মানুষ বৃক্ষরোপণের কথা বলে কিন্তু তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না।’, বলেন তিনি।  

জসিম উদ্দিন বলেন, পরিপক্ক গাছ সূর্যের তাপশক্তিকে বাধা দেয় এবং আর্দ্রতাকে বাষ্পীভূত করে পরিবেশের তাপমাত্রা কমিয়ে আনে।

এদিকে, সবুজায়ন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন দাবি করে গত ১০ বছরে তারা ঢাকা শহরে ২০ লাখের বেশি গাছ রোপণ করেছে। যদি এ বিষয়ে তাদের কাছে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। সেই সঙ্গে রোপণ করা গাছগুলো সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা পেয়েছিল কিনা- তারা নিজেও জানে না।  

তারা জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ কিছু সংস্থা বিভিন্ন সময় নতুন চারা রোপণ করে। কিন্তু, সেই গাছগুলো অবহেলায় নষ্ট হয়ে যায়। এসব কারণেও ঢাকা সবুজায়ন হয় না বলে মন্তব্য করেন তারা।

তারা আরও যোগ করেন, একইভাবে, পরিপক্ব গাছ কেটে ফেলে কংক্রিটের দালান-কোঠা, বাজার, রাস্তা এবং বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি করেছি। বলা যায়— দিনে দিনে গাছ কাটার মতো একটি বেআইনি কাজ  'স্বাভাবিক' হয়ে উঠেছে।

‘ঢাকা সিটিতে শহুরে সবুজ স্থানের বর্তমান অবস্থা এবং ঐতিহাসিক পরিবর্তন: একটি রিমোট সেন্সিং ড্রাইভেন অ্যাপ্রোচ’ শিরোনামের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহর ১৯৮৯ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তার ৫৬ শতাংশ গাছপালা হারিয়েছে এবং এর শহুরে আচ্ছাদন ৮২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ক্রমহ্রাসমান সবুজায়ন ঢাকা শহরের গড় গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা বৃদ্ধির  অন্যতম কারণ।

১৯৮৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকার ওপর তাপপ্রবাহের ফ্রিকোয়েন্সি এবং সময়কাল বাড়ছে।

'আন অ্যানালাইসিস অফ ল্যান্ড সারফেস টেম্পারেচার অব দ্য ঢাকা মেট্রোপলিটন এরিয়া ইন দ্য ল্যান্ডস্যাট ইমেজ অ্যাপ্লায়িং বাই ল্যান্ড সারফেস টেম্পারেচার' শীর্ষক আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৮ এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ভূমি পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মার্চ মাসে ২.৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং মে মাসে ৩.৭৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। গবেষণাটিতে সর্বাধিক নির্মাণকাজ চলে এমন অঞ্চলগুলোর জন্য উল্লেখযোগ্য হারে উষ্ণতা বাড়ার প্রবণতা শনাক্ত করা হয়েছে।

সবুজায়ন নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর আশঙ্কা, ঢাকায় নতুন চারা রোপণের জন্যও জায়গাও পাচ্ছে না। শহরের ৮০ শতাংশেরও বেশি এখন বিল্ট-আপ এলাকা হিসাবে ম্যাপ করা হয়েছে।

দেশের স্বনামধন্য পরিবেশ সংস্থা গ্রিন সেভার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান রনির মতে, ঢাকায় বছরে ৫০ হাজার চারা রোপণের জায়গারও অভাব রয়েছে।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়া, বৃক্ষরোপণের জন্য সরকারি মালিকানাধীন কোনো জমি অবশিষ্ট নেই। সরকারি মালিকানাধীন জমিগুলো বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে; যারা মাঝে মাঝে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গাছ লাগায়। তবে বৃক্ষরোপণ নিয়ে তাদের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো সমন্বয় নেই।

রাস্তার মাঝখানের জায়গার মালিকানা সিটি করপোরেশনগুলোর। বন নগরায়ণ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শহুরে বনায়ন ও তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় সিটি করপোরেশনগুলো ভূমিকা রাখতে পারে।

কিন্তু এখানে কি করতে হবে?

বনায়নের একমাত্র উপযোগী রাস্তার মাঝামাঝি জায়গায় গাছ লাগানোর জন্য টেন্ডারে কাজ করে সিটি করেপারেশনের ঠিকাদাররা। কিন্তু সেখানে শুধু সৌন্দর্যবর্ধন করা গাছ দেখা যায়। আর এই গাছপালা ক্ষণস্থায়ী এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বেশি।

এসব গাছের পরিবর্তে, ঢাকায় বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা কমাতে এবং জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারে এমন ছাউনিযুক্ত গাছের প্রয়োজন, বলছেন গ্রিন সেভারস আহসান রনি।

রনি মনে করেন, রোপণের আগে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গাছ নির্বাচন করা উচিত। তিনি ঢাকার জন্য ঔষধি ও ফলের গাছের সুপারিশ করলেও সতর্কতামূলক বৃক্ষরোপণের ওপর জোর দেন। উদাহরণস্বরূপ, পলাশ, শিমুল, ডুমুর এবং অন্যান্য গাছ, যেগুলোতে পাখির ঝাঁক আশ্রয় নেয়।

তিনি বলেন, ‘আমি রাস্তার মাঝামাঝি বা ফুটপাতে কৃষ্ণচূড়া (ডেলোনিক্স রেজিয়া) লাগানো পছন্দ করিনা কারণ এই সংবেদনশীল গাছটি কাটার কারণে বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।’

রনিকে সমর্থন করে উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক জাসিম মনে করিয়ে দেন, চারা রোপণ, পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত তাদের বেঁচে থাকা এবং শহুরে বনায়ন তৈরি করা সবই বিজ্ঞানের অংশ। তাই বন বিভাগের ছত্রছায়ায় (বন বিশেষজ্ঞদের একমাত্র সরকারি শাখা), নগর কর্তৃপক্ষের সকল স্টেকহোল্ডার এবং উদ্ভিদবিদ্যা বিশেষজ্ঞদের সমন্বিতভাবে কাজ করা উচিত।

জাসিম আরও বলেন, এ প্ল্যাটফর্মটি ঢাকা শহরের ২৫ শতাংশ অঞ্চলের প্রয়োজনীয় সবুজায়নের জন্য একটি রোডম্যাপ সেট করতে বাধ্য করবে। যদি তা হয়  তবে আমরা ১০-১৫ বছর পরে সহনীয় গ্রীষ্ম দেখতে পাব।

বন বিভাগের ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস এম সাজ্জাদ হোসেন অধ্যাপক জাসিমের ‘সুপারিশকে ইতিবাচক’ মনে করেন।

সাজ্জাদ বলেন, ‘শহরের জমির মালিকানা বিভাগটি প্রযুক্তিগত দক্ষতার সঙ্গে ঢাকার নগর বনায়নে নেতৃত্ব দিতে পারে। কাঙ্ক্ষিত সবুজায়ন নিশ্চিত করতে নগর কর্তৃপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় প্রয়োজন।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর