বন বিভাগের আতঙ্ক কে এই মনির!

ময়মনসিংহ, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-23 05:58:17

ভালুকা (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: কে এই মনিরুজ্জামান মনির। নিরস্ত্র বন কর্মীদের কাছে তিনি মূর্তিমান আতঙ্ক। বনের জমি দখলের কারণে এ পর্যন্ত তার নামে ২৯ টি মামলা দায়ের করেছে তবুও তাকে ঠেকানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

বন বিভাগ ছাড়াও আরও অনেক মামলা চলমান তার নামে। পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে ঘোরাফেরা করলেও তার লোমও ছোঁয়ার সাহস করেনা থানা পুলিশ। আবার ক্ষেত্র বিশেষে পুলিশের দুর্বল চার্জশীটে আইনের ফাঁকগলে বেরিয়ে গেছে মনির। এভাবেই দিনে দিনে এলাকার ডনে পরিণত হয়েছেন। বিশেষ করে বন বিভাগের কাছে।

এমনও ঘটনা ঘটেছে সকালে বন বিভাগের লোকজন অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়ে এসেছেন। সন্ধ্যায় আবার লাঠিয়াল বাহিনী দাঁড় করে রেখে দখল নিয়েছেন। বন বিভাগের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে তার দ্বারাই। যেই তার বিরুদ্ধে কথা বলেছে তার উপরেই নেমে এসেছে নানা রকম নির্যাতন।


আরও পড়ুন, বনের জমি দখলের খেলার নাম ‘ডিমার্কেশন’ 

কে এই বাউন্ডারি শহীদ


সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হয়েছেন রাতে বনে টহল দিতে থাকা বন কর্মীরা। রাস্তায় তাদের আটক করে কিলঘুষি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। আবার কখনও কখনও অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয় দেখিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো বিষয়টি কাকতালীয় হতেও পারে। তবে মুনিরের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার পরেই এমন ঘটনাকে কোনো ভাবেই কাকতাল ভাবতে পারেনা বনের লোকজন। যে কারণে তাকে সমীহ করেই চলেন নিরস্ত্র বনকর্মীরা। মনিরের নাম মুখে আনার আগে আশপাশে দেখে নেন কেউ শুনছে কি না।

ভালুকা রেঞ্জের একজন বিট অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেন, গত ১২ অক্টোবর হবিরবাড়ি মৌজায় বনের গাছ কেটে ঘর নির্মাণ করে মনির। বন বিভাগের লোকজন পরে গিয়ে ভেঙে দিয়ে আসে। পরদিনেই আবার লাঠিয়াল বাহিনী দাঁড় করে রেখে ইটের ঘর নির্মাণ করে। এ দফায় অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে অগ্রিম ঘোষণা দিয়ে গিয়ে ঘর নির্মাণ করেন। বন বিভাগের লোকজন জানলেও দুর্গম এলাকা হওয়ায় যাওয়ার সাহস দেখায় নি।


আরও পড়ুন, ১৫৯৯ একর জমির মালিক মল্লিকবাড়ি বন বিট নিজেই ভূমিহীন


কে এই মনির!

তার পুরো নাম মনিরুজ্জামান মনির। বাবার নাম আবুল হোসেন। বারশ্রী গ্রামের বাসিন্দা। হবিরবাড়ি ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ভালুকা রেঞ্জের সদ্য বিদায়ী ফরেস্টার মোস্তাফিজুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ২০০২ সাল পর‌্যন্ত ছিচকে গাছ চোর ছিলো মনির। এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। কমপক্ষে একশ বিঘার মতো বনের জমি দখল করে রেখেছে বলে অভিযোগ বন বিভাগের।

মনিরের নামে প্রথম মামলা হয় ২০০২-০৩ অর্থবছরে। হবিরবাড়ি বিটের মামলা নম্বর ০১/হবি। এর কিছুদিনের মাথায় আবার আরেকটি মামলা দয়ের করে বন বিভাগ। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ১টি, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ৪টি, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৬টি। এক এগারোর সময়ে ভয়ে বনের জমির ধারেও কাছেও ঘেষেন নি। এরপর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে গিয়ে আবার শুরু করেছেন বনের জমি দখল। এই বছরে তার নামে মামলা হয়েছে ২টি, সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। এই বছরে তার বেপরোয়া মনিরকে ঠেকাতে হিমশিম খেতে হয় বন বিভাগকে।

প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকায় তার টিকিটি ছোয়ার চেষ্টা করেনি পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে বন বিভাগ চাইলেও অনেক সময় পুলিশ তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। বনের জমি দখল হচ্ছে খবর পেয়ে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা চাওয়া হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ সাড়া দেয়নি। সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে সময়ক্ষেপণ করেছে।

আবার মামলা দিতে গেলে কয়েকদিন ঘুরিয়ে তবেই মামলা নিয়েছে দায়সারা ভাবে। অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে ২৯টি মামলা দায়ের হলেও অনুপ্রবেশের ঘটনা কয়েক শতাধিক হবে বলে দাবী করেছে বন বিভাগের কর্মীরা। একজনতো বলেই বসলেন, ওর যত কীর্তি যদি সবগুলোর মামলা হতো, তাহলে এক দিনেই আট-দশটি মামলা হওয়ার কথা।

অনেক অফিসার ছিলেন যারা তার সাথে সখ্য গড়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। তারা মামলা দেওয়ার পথে এগোয় নি। আবার মামলা দিলেও কঠোর ধারা না দিয়ে সহজ ধারা দিয়েছেন যাতে সহজেই পার পেয়ে যায়। বন বিভাগের মামলা নিয়েও রয়েছে ভানুমতিন খেল। একই আইনজীবীর সঙ্গে বছরের পর বছর কন্ট্রাক্ট। তার নামেরও রয়েছে নানা রকম মুখরোচক আলোচনা।

বনের জায়গা দখলের পাশাপাশি বনের জমি কেটে মাটি বিক্রি তার অন্যতম পেশা। শুষ্কমৌসুম এলেই তার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে বনের লোকজন। সন্ধ্যায় যখন বনের লোকজন কাজ শেষ করে নিদ্রায় যায়, তখন গহীন বনে শুরু হয় ভেকু দিয়ে মাটি কাটার মহোৎসব। বনের লোকজন অনেক সময় খবর পেলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতে মুখোমুখি হতে চায় না।

বন বিভাগ ও স্থানীয়রা মনে করে অস্তিত্ব সংকটে থাকা  ভালুকা বনকে রক্ষা  করতে হলে মনির ও শহীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। আর তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। না হলে, হয় ভয় দেখিয়ে, না হয় টাকার প্রভাবে পার পেয়ে যাবে।

মনিরুজ্জামান মনির বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি একটু উট্টা যাচ্ছি, যে কারণে মানুষের চোখ পড়েছে। অনেকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারাই আমার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলায় ইন্ধন দিয়েছিলো। বাদী নিজেই মামলা তুলে নিয়েছে।

বনের ২৯ মামলা প্রসঙ্গে বলেন, আমার নামে এতো মামলা নেই। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমুলক সাত-আটটির মতো মামলা দেওয়া হয়। ৮০ ভাগ মামলায় আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি। বনের কোনো জমি আমি দখল করিনাই। আমি যেগুলো জমি ভোগ দখল করি সেগুলো আমার বাব-দাদার পৈত্রিক।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা একেএম রুহুল আমিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, আগে কি হয়েছে জানি না। আমি সম্প্রতি এসেছি, বনের জমিতে যেই আসুক তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। প্রশাসনে অনেক ভালো ভালো অফিসার রয়েছে, যারা আমাদের দারুণভাবে সহযোগিতা করছে। আমরা এরই মধ্যে অনেক জমি উদ্ধার করে বনায়ন করেছি। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর