মিশ্র বহরে বিমানের ক্ষতি ১৮০০ কোটি টাকা

, জাতীয়

ইশতিয়াক হুসাইন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-05-25 19:03:33

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ দরকার। আর তাই বিমানও নতুন উড়োজাহাজ সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে বিমান তার বহরের জন্য এয়ারবাস নাকি বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ কিনবে।

আর এই আলোচনার মধ্যে নতুন একটি তথ্য উঠে এসেছে। তথ্যমতে বিমান যদি মিশ্র বহরে যায় (বোয়িং ও এয়ারবাস) তাহলে প্রতিষ্ঠানটির এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা লোকসান হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং বলছে, এ নিয়ে বোয়িংয়ের বিস্তারিত সমীক্ষা রয়েছে। তাদের সমীক্ষা বলছে, বিমান যদি মিশ্র বহর তৈরি করে আগামী ২০ বছরে ১৫০ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ক্ষতি হবে। মূলত প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, স্পেয়ার পার্টস ও বৈমানিকদের প্রশিক্ষণের জন্যই এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হবে। একটি বহরে যদি ১০টি বোয়িং ৭৮৭ এবং ১০টি এয়ারবাস এ৩৫০ উড়োজাহাজ থাকে সেক্ষেত্রে বৈমানিক বেশি লাগবে।

বোয়িংয়ের কথা, যেসব এয়ারলাইন্সের মিশ্র বহর রয়েছে তাদের হিসেব ভিন্ন। যেমন মিশ্র ফ্লিটের খরচ বাঁচাতে ইন্ডিগো এয়ারবাস কিনছে। যেহেতু তাদের বহরে আগে থেকেই এয়ারবাস রয়েছে। তবে বিমানের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না। বোয়িং বলছে, বিমান কেন মিশ্র বহর তৈরি করে ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি অর্থ খরচ করবে।

এয়ারবাস বলছে, বেবিচকের নিরীক্ষা অনুযায়ী ২০২২ সালে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলো প্রায় এক কোটি আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিচালনা করেছে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৫ লাখের কিছু বেশি। ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ আকাশপথের যাত্রী সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। নতুন এই যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা অর্জন করতে হলে বিমানের বহু সংখ্যক উড়োজাহাজ প্রয়োজন।

মূলত গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর বাংলাদেশ সফরের সময় থেকে বিমানের এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কেনার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর থেকে উড়োজাহাজ বেচতে বোয়িংয়ের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। বোয়িং অনেক আগে থেকে নতুন উড়োজাহাজ বিক্রি করতে বিমানের সাথে দেনদরবার করে আসছিল। তবে যখন দেখলো যে, বিমান এয়ারবাসের উড়োজাহাজ পেতে অনেকখানি এগিয়েছে, তখন তাদের তরফেও বিমানে আসা-যাওয়া বেড়ে যায়। বোয়িংয়ের কর্মকর্তারা ছাড়াও ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও বিমানের সাথে বৈঠক করেন।

এদিকে, এয়ারবাস কেনার বিষয়ে বিমান এরই মধ্যে প্রস্তাব যাচাই-বাছাই ও দরকষাকষিসহ পুরো প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে একটি কমিটি করে দিয়েছে। ওই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই বিমান অগ্রসর হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এয়ারবাস কেনার বিষয়ে বিমান অনেকদূর এগিয়েছে।

বোয়িংয়ের ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রায়ান উয়্যার, ইউরেশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশের বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অশ্বিন নাইডু ও বোয়িং বিক্রয় পরিচালক কান্তি ভুবনাগিরি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন।

ঢাকায় ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত কয়েকদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী ফ্রান্স সফরের আগে এ বিষয়ে চুক্তি হবে বলে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন।

বোয়িং বলছে, বিমান যদি ৭৮৭ ড্রিমলাইনার দিয়ে যাত্রী পরিবহন করে তাহলে এতে বছরে তাদের ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি লাভ হবে। এছাড়া ড্রিমলাইনের তাদের ৬ শতাংশ কম জ্বালানি লাগবে, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমবে ৩০ শতাংশ এবং বোয়িংয়ের অন্য প্রতিযোগির চেয়ে কম দাম পাওয়া যাবে তাদের উড়োজাহাজ।

বিমান চারটি ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ও দুটি ৭৭৭ ফ্রেইটার (ওয়াইড বডি মালবাহী) উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে।

বোয়িংয়ের নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়ে সব ধরনের প্রমাণ তারা দিয়েছেন বিমানকে। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে যদি আরও নিশ্চিত হতে হয় সেজন্য প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একজন বিশেষজ্ঞকে ঢাকায় আনারও প্রস্তাব করেন তারা।

সম্প্রতি বিমানের ৭৮৭ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজের উইন্ডশিল্ড ভেঙে যাওয়ার বিষয়ে বোয়িং বলছে, এটা হতেই পারে। তবে তারা বিশ্বাস করেন না যে, এটি পণ্যের মান সংক্রান্ত কোনো ইস্যু। কারণ একটি উড়োজাহাজ বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলাচল করে। এ কারণে উইন্ডশিল্ড দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফাটল সৃষ্টি হতেই পারে।

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সটিতে বর্তমানে শুধুমাত্র বোয়িংয়ের উড়োজাহাজই রয়েছে ১২টি। প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই উড়োজাহাজগুলো কেনা হয়।

লাভ-লোকসান কি প্লেনের কারণেই হয়

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বোয়িংয়ের এই উড়োজাহাজগুলোর শতভাগ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এই ফ্লিট অনুযায়ী আমরা নতুন রুট চালু করতে পারিনি, এছাড়া বিমানের বৈমানিকসহ অন্যান্য জনবলের ঘাটতি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, এসব-ই হয়েছে বিমানের দুর্বল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার কারণে।

কি বলছে বিমান

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিম বলছেন, বিশ্বের বড় বড় এয়ারলাইন্সে বোয়িং ও এয়ারবাস উভয় কোম্পানির উড়োজাহাজ থাকে। তাছাড়া এয়ারবাস কেনা হলে এককভাবে বোয়িংয়ের ওপর নির্ভরশীলতা কমাবে।

‘নতুন উড়োজাহাজ এলে বিমানের নেটওয়ার্ক সম্পসারণ করা হবে। কানাডায় আরও ফ্লাইট বাড়ানো, নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুসহ আরও নতুন রুট চালু করা হবে,’ যোগ করেন তিনি।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

তবে বিমান কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিমানকে নতুন কোম্পানির উড়োজাহাজের জন্য বৈমানিক, কেবিন ক্রু ও প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে। আর বিমান এখনো তাদের বর্তমান সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর