ত্রিধাবিভক্ত বরিশাল আওয়ামী লীগ, কমিটি বিলুপ্তিতে নেতৃত্বশূন্য বিএনপি

  • এস এল টি তুহিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,বরিশাল
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

হতাশা, বঞ্চনা ও ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়নের ফলে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বরিশালের আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ফলপ্রসূ আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় হঠাৎ বিলুপ্ত হওয়া কমিটি নিয়ে নেতৃত্বশূন্য এখন বরিশাল বিএনপি। দল দুটোর মধ্যে ক্ষমতার প্রদর্শনী থাকলেও কেউই বরিশাল তথা দল ও দেশপ্রেমিক নেতা ছিলো না বলে অভিযোগ বরিশালের সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। যদিও এসব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন দুটি রাজনৈতিক দলের জেলা ও মহানগর নেতারা।

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের খুব একটা প্রভাব মহানগরে না থাকলেও জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের মধ্যে বিগত জাতীয় নির্বাচন থেকেই বিভক্তি চোখে পড়ে। তবে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে গত ষষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনকে ঘিরে। প্রথমদিকে আনারস প্রতীকের পক্ষে বরিশাল-৫ আসনের সংসদ সদস্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এবং সিটি মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতকে দেখা গেলেও পরবর্তীতে জাহিদ ফারুকের সমর্থন চলে যায় মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে। তার সামনেই মোটরসাইকেল ও আনারস প্রতীকের প্রার্থীরা অসৌজন্যমূলক আচরণ করলেও তিনি নীরব থাকেন। এ নিয়ে কানাঘুষা সৃষ্টি হলে প্রতিমন্ত্রী ও মেয়র দ্রুত একসাথে সভা করে বুঝিয়ে দেন তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।

বিজ্ঞাপন

এরআগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাথে মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত এবং সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের মধ্যে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়। বিশেষ করে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ পক্ষের লোকেরা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এ সময় স্লোগান ওঠে জাহিদ-খোকন দুই ভাই, বরিশালে আর সমস্যা নাই। এর অল্পদিন পরেই উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনকে ঘিরে মেয়র-প্রতিমন্ত্রী দূরত্ব তৈরি হয়। যা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয় সুশীল সমাজেও।

উপজেলা চেয়ারম্যানকে ঘিরে মেয়র ও প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে দাবি করছেন বরিশালের একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলেন, আনারস প্রতীকের প্রার্থী মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন ছিলেন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের একান্ত ঘনিষ্ঠ লোক। হঠাৎ করে মাহমুদুল হক খান মামুনকে আর প্রতিমন্ত্রীর পাশে দেখা যায় না, বরং সেখানে এখন স্থান পেয়েছে মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী এসএম জাকির। আর এলাকার সবাই জানেন এসএম জাকির সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যে কারণে মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত তাকে অপছন্দ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তো আরও কিছু জটিলতাও আছে, যা আমরা সাধারণ চোখে বুঝতে পারছি না। যা নিয়ে মেয়র ও প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান তারা। বিশেষ করে ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্লাটিনাম জয়ন্তী উদযাপন সময়ে মহানগর সহসভাপতি আইনজীবী আফজালুল করিমের বক্তব্যে তা আরও স্পষ্ট হয়েছে বলে দাবি সুশীল সমাজের।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নগর চিন্তাবিদদের একজন কাজী মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আমি যেটা বুঝি, এই ৬৬ বছরের জীবনে আমি বরিশালে প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণ ছাড়া এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পেলাম না, যার পিছনে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন রয়েছে। এখানে এখন যা দেখি তা টাকা আর ক্ষমতার প্রদর্শনী শুধু। বরিশালের জন্য বা দল ও দেশের জন্য ভালোবাসা আছে, এমন নেতার খুবই অভাব বরিশালে।

এদিকে নগর চিন্তাবিদদের একজন বরিশাল সাহিত্য সংসদ এর সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কেএসএ মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক বলেন, আওয়ামী লীগের প্লাটিনাম জয়ন্তী বা ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করতে প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে লস্কর নুরুল হক, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আইনজীবী আফজালুল করিমসহ কয়েকজনকে দেখা গেছে পৃথক অবস্থানে। মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতের পাশে এসময় মাহমুদুল হক খান মামুনসহ কয়েকজন ছিলেন। ২৩ জুন মেয়রের উদ্যোগে প্লাটিনাম জয়ন্তী উদযাপন র‍্যালি বা সমাবেশে প্রতিমন্ত্রী কিংবা জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কাউকে দেখা যায়নি। আবার মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তার লোকজন নিয়ে পৃথকভাবে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও সমাবেশ র‍্যালি করেছেন। চাচা-ভাতিজার লোক সমাগমের একটা প্রতিযোগিতা দেখা গেছে এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে। যেখানে প্রতিমন্ত্রী পক্ষের কাউকে দেখা যায়নি বলে জানান তিনি।


বরিশালে বিএনপির বর্তমান অবস্থা

গত ১৩ জুন বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে হঠাৎ করে মহানগর বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে জেলা ও মহানগর বিএনপিতে চলছে চরম অস্বস্তি। নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার সম্ভাবনায় জোর লবিং ও তদবিরে ব্যস্ত নেতাদের অনেকে। তালিকায় আছেন সাবেক ও বর্তমান নেতাদের অনেকেই। তবে আলোচনায় এবায়দুল হক চান, মনিরুজ্জামান ফারুক ও জিয়াউদ্দীন সিকদারের নাম প্রথম সারিতে। কেউ কেউ আবার বলছেন, এবার চমক দেখাবেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার।

গত প্রায় আড়াই বছর ধরেই বরিশাল মহানগর বিএনপি আহ্বায়ক কমিটি নির্ভর। পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বারবার পিছিয়ে যাওয়ার কারণে বরিশালে দলটির নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হচ্ছে বলে জানালেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী। তিনি বরিশালে বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।

২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি গঠিত মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব ও বিতর্কের মধ্যেই একই সালের ১১ মার্চ সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। ৩০টি কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা সবাই সাবেক এমপি ও মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারী ছিলেন। ফলে মহানগরের রাজনীতিতে মজিবর রহমান সরোয়ার ও তার অনুসারী নেতা-কর্মীরা একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ নিয়ে বিভিন্ন সমাবেশে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতও দেখা গেছে। এমন অবস্থার মধ্যেই গত ১৩ জুন গভীর রাতে বরিশাল মহানগর কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। ১৪ জুন শুক্রবার সকালে কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়।

গুঞ্জন ওঠে, তাহলে কি বরিশাল মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে আবারও মজিবর রহমান সরোয়ারের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা হচ্ছে? কেউ কেউ আবার বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানকে ও এজন্য দায়ী করেন এ জন্য। তবে এখানে তাদের কোনো হাত নেই বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন বিএনপির এই দুই নেতা। বিলুপ্ত হওয়া আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কমিটি বিলুপ্ত করা হবে, তা আগে থেকে কোনো নেতাই জানতেন না।

বিলুপ্ত হওয়া কমিটির সদস্য ও দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা জাহিদুর রহমান বলেন, ‘হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। কবে নাগাদ পুনরায় কমিটি করা হবে, সে ব্যাপারেও আমরা সবাই অন্ধকারে আছি।’

কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পরদিন থেকেই অনেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে। তবে তারাও নতুন কমিটি নিয়ে কোনো তথ্য পাচ্ছেন না। এ নিয়ে বিলুপ্ত কমিটির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘কমিটি বিলুপ্ত করার বিষয়টি আমরা আগে থেকে জানতাম না। তবে তিন মাসের আহ্বায়ক কমিটি আড়াই বছরের বেশি সময় পার করেছে। তাই বিলুপ্ত করা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলেই মনে হচ্ছে।’

অন্যদিকে বিলুপ্ত হওয়া কমিটির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক বলেন, হঠাৎ করে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এটা আরও আগেই হওয়া উচিত ছিলো। একটানা আড়াই বছর আহ্বায়ক কমিটি চলেছে। এখন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত যা হবে আমরা তা-ই মেনে নেব। আশাকরি শীঘ্রই পূর্ণাঙ্গ কমিটি পাবে বরিশাল বিএনপি। একই কথা বলেছেন বিএনপির সাবেক জেলা সভাপতি এবায়দুল হক চান ও একই কথা বলেন সাবেক কাউন্সিলর ও বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার। তিনি বলেন, দলকে ভালোবাসি দলের একজন কর্মী হিসাবে আমরণ থাকতে চাই। তবে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত যা-ই হোক সেটাই মেনে নিতে প্রস্তুত আছি বলে জানান তিনি।