ফেনীতে বাড়ছে অনলাইন জুয়ার আসক্তি

, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,ফেনী | 2024-06-25 13:05:59

প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই ফেনীর একটি প্রতিষ্ঠানের ১৩ জন কর্মচারী এক সাথে মেতে ওঠেন জুয়া খেলায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাদেরই একজন জানান, এ মাসের বেতনের ১০ শতাংশ পরিবারের জন্য খরচ করতে পারিনি। অধিকাংশই জুয়া খেলায় ব্যয় হয়েছে।

এভাবে সন্ধ্যা হলে সকল কাজ স্থগিত করে ফেনীর বিভিন্ন মার্কেট ও বাজারের দোকান কর্মচারীরা আইপিএলসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছোটখাট জুয়ায় মেতে ওঠেন। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে আড্ডার স্থান সবজায়গায় চলে জুয়া নিয়ে মাতামাতি। প্রতি বল, ওভার, কোন দল জিতবে, কোন খেলোয়াড় কত রান করবে, কোন বোলার কয়টা উইকেট নেবে- এমন অনেক বিষয় নিয়ে বাজি ধরা হয়। বর্তমানে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে মোবাইলে বিভিন্ন এ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ায় বাজি ধরা হচ্ছে। যাদের বেশির ভাগই উঠতি বয়সী তরুণেরা। অনলাইন জুয়া নিয়ে অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ফেনীতে কতজন এ অনলাইন জুয়া জড়িত হয়েছেন তার নির্দিষ্ট করে না জানা গেলেও জানা গেছে এর বিস্তার ফেনীর প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে ও সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তির দেওয়া। তথ্যে জানা গেছে, লোভে পড়ে বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও তরুণেরা এই জুয়ায় বেশি আসক্ত হচ্ছেন। পৌর এলাকা থেকে শুরু করে উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় এই জুয়া বিস্তার লাভ করছে। তরুণদের অনেকেই কৌতূহলবশত এই খেলা শুরুর পরেই নেশায় পড়ে যাচ্ছেন। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময় খোয়া যাচ্ছে হাজার হাজার টাকা।

ফেনীর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির ছাত্র রবিন (ছদ্মনাম)। পাড়ার বড় ভাইদের দেখাদেখি আইপিএল ঘিরে চলা জুয়ার ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে পড়ে সে। কৌতূহল মেটাতে বড় ভাইদের সাহায্য নিয়ে সেও নাম লিখায় অনলাইন জুয়ার খাতায়। প্রতিদিনই বাবা-মা এমনকি বন্ধু বান্ধবদের কাছ হতে টাকা ধার করে ছোটখাট জুয়া খেলতে শুরু করে সে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার জুয়ায় আসক্তি। প্রথমে ছোটখাট অংকের বাজি ধরলেও ক্রমেই বাড়তে থাকে তার পরিমাণ। বেশির ভাগ সময় লাভের অংক শুণ্যই থাকে তার, তবে জুয়ার আসক্তি কোনভাবেই পিছু ছাড়ছে না তাকে। সন্ধ্যা হলেই মোবাইল হাতে পাড়ার মোড়ে বন্ধুদের সাথে অথবা ঘরে বসে অনলাইনে চোখ থাকে তার মোবাইল অথবা টিভির স্ক্রীনে।

রবিনের মত এমন অনেক জনের সাথে কথা হয় এ বিষয়ে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে ফেনীতে আইপিএল ঘিরে জুয়ায় খেলায় যুক্ত রয়েছে প্রায় ২০ হাজারের বেশি তরুণ। যাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফেনীর বাইরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এতে যুক্ত রয়েছে। জুয়া খেলতে কি পরিমাণ টাকা লগ্নি করছে এ ব্যাপারে কোন নির্দিষ্টতা নেই। তাদের ধারণা মতে টাকার অংকের পরিমাণ অকল্পনীয়। তবে বিশ্বব্যাপী অনলাইন জুয়ার কাছে এ পরিমাণ কিছুই না।

জানা গেছে, অনলাইন জুয়ায় শুরুর দিকে ভালো লাভ হতে থাকে। কিন্তু তার পরেই লোকসানের পাল্লা বাড়তে থাকে। তাতে লগ্নি করতে বিভিন্ন উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন অনেকে। জেনে-শুনে এমন পথে কেন জড়ালেন এ প্রশ্নের জবাবে উত্তর মেলে, এটি নেশার মতো। খেলা শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে, ততক্ষণ খেলতে ইচ্ছা করে।

ফেনীর জেল রোডে এলইডি স্কিনের সামনে প্রায় সময় বিভিন্ন খেলা দেখানো হয়। সেখানে দেখা মিলে কয়েকজন যুবক মোবাইল হাতে ব্যস্ত। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনলাইন জুয়ার সাইটে বেটিং করতে ব্যস্ত তারা। বল টু বল কিংবা ওভার টু ওভার বেট করছেন তারা। এভাবেই প্রতিনিয়ত জুয়া খেলেন বলে জানান তারা।

অনলাইনের বিভিন্ন সাইট ঘুরে দেখা যায়, নামে বেনামের প্রায় ১০ থেকে ১২টির মতো অ্যাপসে সবচেয়ে বেশি জুয়া খেলা হয়। এসব অ্যাপসে ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো অঙ্কের টাকা দিয়ে শুরু করা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রলোভনে প্রচার করা বিজ্ঞাপনে এসব জুয়া বা বেটিং সাইটে ঢুকে পড়ে তারা। বুঝে না বুঝে কেউ একটি ক্লিক করলেই অ্যাপস কিংবা ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। শুরুতে সদস্য টানতে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন কৌশল। অল্প টাকায় লাখপতি হওয়া বা দ্বিগুণ মুনাফার লোভে অন্ধকার এ জগতে পা বাড়াচ্ছেন সব শ্রেণীরপেশার মানুষ।

এ বিষয়ে ফেনীর একটি কলেজের শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যুব সমাজের অধঃপতনের আরেকটি মাধ্যম অনলাইন জুয়া। উঠতি বয়সী প্রায় অধিকাংশ তরুণের মোবাইল ফোনে অনলাইন জুয়ার সাইটের দেখা মিলে। এটি পারিবারিক ভাবে সতর্কতার পাশাপাশি সরকারের জাতীয়ভাবে প্রদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার এসব সাইট বন্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।


এদিকে দেশের ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, অনলাইন জুয়া থেকে জনগণকে দূরে রাখার জন্য সচেতনতা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সোমবার (২৪ জুন) সচিবালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুইয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

অনলাইন জুয়া বন্ধে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জুনাইদ আহমেদ বলেন, 'আমরা অবৈধ জুয়ার সাইটগুলোকে ব্লক করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি একটা সচেতনতা তৈরি করার চেষ্টা করছি। যাতে সাধারণ মানুষ এ ধরনের কোনো প্রলোভনে পড়ে প্রতারিত না হন। আমাদের দেশের মুদ্রা যাতে বিদেশে পাচার না হয়। একটা সচেতনতা আর একটা প্রযুক্তিগত প্রয়োগ, পাশাপাশি কঠোর আইনের প্রয়োগ। তিনি জানান, আমরা মোট ২ হাজার ৬০০টি জুয়ার সাইট ব্লক করেছি। এখন আমরা মোবাইল অ্যাপগুলো প্রতিনিয়ত ব্লক করছি। এটা চলমান প্রক্রিয়া।'

বিষয়টি নিয়ে ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকম, ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার, কম্পিউটার কাউন্সিল, বিটিআরসি ও সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি সবাইকে নিয়ে বসেছিলেন বলে জানান প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

তিনি বলেন, 'যার যতটুকু সক্ষমতা আছে, পুলিশ ও ইন্টেলিজেন্স- সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে একটা ড্রাইভ দিচ্ছি। আরও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে আমরা অবিরাম এটা ব্লক করতে থাকব। মিডিয়াসহ বিভিন্ন সোর্সে আমরা যেটা পাচ্ছি, সেটা ব্লক করার চেষ্টা করছি।'

সচেতন মহল বলছেন, এখনই অনলাইন জুয়ার বিস্তার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের একেবারে নিম্ন পর্যায়ের মানুষও এতে জড়িয়ে পড়ছে। দ্রুত এসব সাইট বন্ধ করা দরকার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর