দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে কবিরাজি বিজ্ঞাপন, মন্ত্রে সমাধানের আশ্বাস

, জাতীয়

মশাহিদ আলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট | 2024-07-01 08:44:54

'বোনজামাই আপনাদের খোঁজ নেয় না বা যোগাযোগ করে না। তাকে যদি বাধ্য করা হয় তাহলে কথা শুনবে। যেমন তার নাম দিয়ে আপনাদের ওপর বাধ্য করলাম। তখন সে আপনাদের প্রতি আটকা পড়বে। তখন আপনারা যে কথা বলবেন সে সেই কথা শুনবে। কথার অবাধ্য হবে না। এখন আপনি আমাকে তার নাম, আনুমানিক বয়স, বর্তমান ঠিকানা দেন এবং আপনাদের যাদের নামের ওপর বাধ্য করবো সবার নাম দিতে হবে। আমি কাজ করে দিলে সে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে আপনাদের প্রতি বাধ্য হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে হাদিয়া হিসেবে আমাকে দিতে হবে ৩ হাজার ২০০ টাকা। কারণ তাকে বশ করতে হলে আমাকে আয়োজন করতে হবে ১২ পয়েন্ট জাফরান কালি, একজোড়া কবুতর ও দুইটা মাটির কলস লাগবে। এই জিনিসগুলো নিয়ে আমি চালান বশকরণ করে দেবো মরার আগ পর্যন্ত লাইফ গ্যারান্টি কাজ করবে। টাকা দিয়ে দিলে কাজ শুরু হয়ে যাবে।'

কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক কবিরাজ হাজী জুনাইদ হাসান। এই প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে কথা বলতে গেলে ওঠে আসে তন্ত্র-মন্ত্রের বিষয়টি। মন্ত্র দিয়ে মিলছে এমন বিভিন্ন সমস্যার সমাধান। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরাসরি যেতে হবে না তান্ত্রিক ওঝা বা কবিরাজের কাছে। ঘরে বসেই ১৮-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মিলবে সমাধান। শুধু বিকাশে হাদিয়া আর নাম ঠিকানা দিলেই হয়ে যাবে কাজ।

এমন কিছু বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে দেয়ালে দেয়ালে। শুধু তন্ত্র-মন্ত্রই যে শেষ তা কিন্তু নয়। রাস্তার পাশে ভ্যান বা ঠেলাগাড়িতে কবিরাজি ওষুধ ও যৌন উত্তেজক ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই। এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগের দিচ্ছেন চিকিৎসা। আর এসব বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন আর কেউ কেউ প্রতারিত হচ্ছেন।

তবে, মানুষকে এসব বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি বলে জানিয়েছেন সিলেটের সিভিল সার্জন। আর ওষুধ প্রশাসন বলছে, তারা প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকায় অভিযান পরিচালনা করছেন।

সিলেটে শহরে এবং শহরের বাহিরে অলিতে গলিতে, রাস্তাঘাটে, বৈদ্যুতিক খুঁটি, দোকানপাটের দেয়ালে শোভা পেতে দেখা যায় বিভিন্ন কবিরাজের লিফলেট ও পোস্টার। এসব পোস্টার কোথাও রঙিন কোথাও সাদা কালো। কোনোটায় বিভিন্ন প্রাণির ছবি। আবার কবিরাজের নিজের ছবিও দেওয়া রয়েছে।

শুধু তন্ত্র-মন্ত্রেই মিলবে সব ধরনের সমস্যার সমাধান

তন্ত্র মন্ত্রে মিলে যেসব সমস্যার সমাধান

যৌন দুর্বলতা থেকে বন্ধ্যত্ব দূরীকরণ, জায়গা-জমির বিরোধ থেকে বিদেশে অশান্তি দূরীকরণ পর্যন্ত তাদের ক্ষমতা, দাম্পত্য জীবনে অসুখী, পারিবারিক কোনো সমস্যা অথবা বিয়ে হচ্ছে না, কাউকে ভালোবাসেন বশ করতে চান কোনের সমস্যা নেই সব কিছুর সমাধানের মন্ত্র। এছাড়া ক্যান্সারের চিকিৎসা দিচ্ছেন তারা বিভিন্ন সুপার মার্কেট, কেউ বা দিচ্ছেন নিজের বাড়ি বা এলাকায় থেকে, মোবাইল বা কুরিয়ার সার্ভিসে।

কেউ চট্টগ্রাম থেকে কেউবা খাগড়াছড়ি ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকেই দিব্যি বিশাল বিশাল সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা। তেমনি একজন হলেন আন্তর্জাতিক কবিরাজ হাজী অলউল্লা। তিনি ভারতের কামরূপ-কামাখ্যা থেকে ২১ বছরের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও ০১০ জন কবিরাজের ওস্তাদ। তিনি অবাধ্য গোপনীয় সমস্যার সমাধানসহ বিয়ে-সাদি না হওয়া, অবাধ্য কে বাধ্য করা, শত্রুকে দমন করা, বান-টোনা, ছেলে-মেয়ের অমিল, যাদের সন্তান হয় না মানে বন্ধ্যত্ব দূরীকরণ, যৌন দুর্বলতা থেকে মুক্তি পাওয়াসহ আরও অনেক বিষয়ে তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ কবিরাজ।

তবে, তার মুঠোফোনে কল দিয়ে মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

আরেকজন হলেন চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক কবিরাজ হাজী জুনাইদ হাসান। তিনিও ভারতের কামরূপ-কামাখ্যা থেকে ২১ বছরের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও ৩১০ জন কবিরাজের ওস্তাদ।

দেয়ালে পাওয়া এসব লিফলেট ও পোস্টার দেখে গ্রামের বেশির ভাগ লোক আকৃষ্ট হয়ে থাকেন। কেননা গ্রামে এখনও প্রায় কুসংস্কার রয়ে গেছে। তবে গ্রামের পাশাপাশি এখন শহরের লোকদের আগ্রহ বাড়ছে। তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা শাস্ত্রেও যেসব বিষয়ের চিকিৎসা নেই, এই তান্ত্রিকরা তন্ত্র-মন্ত্র দিয়েই তা সারিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার পুরাতন পুলের মুখ এলাকায় ঠেলাগাড়ি ও ভ্যানগাড়িতে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন কবিরাজি ওষুধ। পাশাপাশি বিক্রি করছেন বিভিন্ন যৌন উত্তেজক ওষুধপত্র। কিন্তু নেই তাদের কোনো লাইসেন্স বা অনুমোদন। এমনকি কোম্পানির লোকদের মোবাইল নম্বর চাইলেও দিতে পারেননি। নিজেদের ভুলও স্বীকার করেন ক্যামেরার সামনে।

ওষুধ প্রশাসনের সিলেট জেলার ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক মো. শামীম হোসেন বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। অভিযোগ পাওয়া মাত্র আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। আমি যতদ্রুত সম্ভব এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবো।

এ বিষয়ে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনসির চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন জায়গায় যে অপপ্রচার বা দেয়ালে প্রচার করা হচ্ছে আমার মতে এগুলো ঠিক না। জেলা ও উপজেলাগুলোতে যেসব কবিরাজ বা যারা এগুলো নিয়ে ব্যবসা করেন তারা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে থাকেন। আমাদের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ থেকে এসবের বিরুদ্ধে সব-সময় প্রচার প্রচারণা করে থাকি। আমাদের প্রচারণা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সকলকে সচেতনতার মাধ্যমে এটা থেকে উত্তরণ হতে পারবো বলে আমি মনে করি।

তিনি আরও বলেন, ক্যান্সার খুবই মারাত্মক একটা রোগ। এটার বিজ্ঞানসম্মত যে পদ্ধতি আছে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা নেওয়া উচিত। এই রোগের জন্য বড় বড় ক্যান্সার হাসপাতাল রয়েছে সেখানে রোগীরা চিকিৎসা নেবে। ওষুধ প্রশাসন কর্তৃক যেসব জায়গা রয়েছে সেখান থেকে ক্রয় করলে মানুষ প্রতারিত হওয়া থেকে বাঁচতে পারবেন বলে মনে করি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর