বরেন্দ্রর মেঠোপথে বর্ষার ছোঁয়া, কৃষকের মুখে হাসি

, জাতীয়

মোঃ আব্দুল হাকিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী | 2024-07-01 19:49:40

আষাঢ় মাসের তৃতীয় সপ্তাহের প্রথম প্রান্তে ছিল ভ্যাপসা গরম ও রোদের দাপট। আষাঢ়ের মাস হলেও অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে রাজশাহী অঞ্চলের আউশ ধান চাষ ব্যাহত হচ্ছিল। ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ায় অনেক বীজতলা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চারা রোপণ করে কৃষকেরা পড়েছিলেন দুশ্চিন্তায়।

তবে আষাঢ়ের তৃতীয় সপ্তাহের শেষে বরেন্দ্র অঞ্চলের মেঠোপথে ঝরেছে মুসলধারে বৃষ্টি। আউশ আবাদে ফিরেছে প্রাণ। অনাবৃষ্টিতে তেঁতে ওঠা প্রকৃতিতেও এসেছে স্বস্তি।

অনেকদিনের খরার পর এই বৃষ্টি যেন কৃষকের দুঃখ ঘুচিয়ে দিয়েছে। জমিতে জমে থাকা ধুলোর আস্তর যেন ধুয়ে মুছে একেবারে পরিষ্কার। নতুন উদ্যমে আবারও শুরু হবে আউশের আবাদ। প্রকৃতির এই বৈপরীত্যই যেন জীবনের চলমানতার চিরন্তন দিক।

এমন বর্ষণই কৃষকেরা অপেক্ষায় ছিলেন দিনের পর দিন। শস্যের চারাগুলো যেন তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে। সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। মাঠে মাঠে সোনা ফলানোর স্বপ্ন আবারো জেগে উঠলো।

মেঘের ডাক, বৃষ্টির গান, এই বর্ষা যেন ধান ক্ষেতে নবজীবন এনে দিয়েছে। কৃষকের হৃদয়ে শান্তির পরশ। এক সময়ের শুষ্ক প্রান্তর এখন জলের আদরে সিক্ত। কৃষকের কষ্ট আর দুশ্চিন্তা সব ভেসে গেছে এই বৃষ্টির স্রোতে।

ধান রোপণ করছেন   

রাজশাহীর আকাশে মেঘের আনাগোনা, বর্ষার এই স্বস্তি যেন টেনে নিয়ে আসলো প্রকৃতির হারানো সজীবতা। কৃষকের মুখে এখন শুধুই হাসি, তাদের চোখে নতুন স্বপ্নের আলো। অনাবৃষ্টির সেই দিনগুলো যেন এখন শুধুই অতীতের গল্প।

এভাবেই আষাঢ়ের বর্ষণমুখর প্রান্তর জানান দিল, প্রকৃতির চিরন্তন নিয়মে সব কিছুই আবার ঠিক হয়ে যাবে। কৃষকের হৃদয়ে তাই এখন শুধুই আনন্দের সুর। এই বৃষ্টি তাদের নিয়ে এসেছে নতুন জীবনের বার্তা।

গ্রীষ্মের গনগনে তাপে যখন প্রান্তরের মাটি ফেটে চৌচির, তখন বর্ষার প্রথম কদম ফুলের মতোই প্রত্যাশিত এই বৃষ্টি। শস্যক্ষেতের ক্লান্ত মাটিতে স্বস্তির বারিধারা। কৃষকের মুখে ফুটে ওঠা হাসি যেন প্রকৃতিরই প্রতিফলন। মহামারির পর এক ধরনের মনোবলেই যখন দাঁড় করিয়েছে কৃষক, তখন প্রকৃতির এমন অনুকূলতায় তাদের প্রাণে ফিরে এসেছে নতুন আশা।

কৃষকেরা বলছেন, দুই মাস ধরে ধানচাষ শুরু হলেও পানির অভাবে মাঠ-ঘাট খাঁখাঁ করছিলো। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত অর্ধেক জমিতে আউশের চারা রোপণ করা সম্ভব হয়নি। রোপণ করা আউশ আবাদও রোদে পুড়ে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে এই আশীর্বাদের বৃষ্টি ফসলের ক্ষতি থেকে বাঁচিয়েছে।

পবা উপজেলার কৃষক মুখলেশ আলি বলেন, বর্ষা মৌসুম হলেও বৃষ্টি যেন অভিমান করে রয়েছে। আউশ ও আমন ধান চাষের জন্য বৃষ্টিই ভরসা। সেচ ছাড়াই সাধারণত জমি সবুজে ভরে ওঠে। কিন্তু এবার জমিতে চারা রোপণ করতেই সেচ দিতে হচ্ছে, রোপণ করার পরও সেচ দিতে হচ্ছে। এতে ব্যয়ের বোঝা আরও বেড়ে যাচ্ছে। আশেপাশের কিছু জমিতে ধান রোপণ করে অনেকে বিপাকে পড়েছেন। তাই বৃষ্টির জন্য প্রতীক্ষায় ছিলাম। বৃষ্টি হওয়ায় স্বস্তি ফিরে এসেছে। কাল থেকেই ধান রোপণের কাজ শুরু করবো।

তানোর উপজেলার কৃষক আব্দুল বারি বলেন, বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিলাম দীর্ঘদিন। জমিতে পানি না থাকায় আউশ ও আমন ধান চাষে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বৃষ্টির অভাবে চারা রোপণ করতেও বাধ্য হচ্ছিলাম সেচের পানি ব্যবহার করতে, যা বাড়তি খরচের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চারপাশের জমিতে ধান রোপণ করেও অনেকে বিপাকে পড়েছিলেন। রোববারের বৃষ্টিতে স্বস্তি ফিরে এসেছে, আবার নতুন করে আশার আলো দেখা দিয়েছে।


গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষক মোতাল্লেব হোসেন বলেন, এই মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। আউশ ও আমন ধান চাষে বৃষ্টির পানি ভরসা, কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় জমিতে সেচের পানি দিয়ে চারা রোপণ করতে হচ্ছিল। এতে খরচও বেড়ে যাচ্ছিল। আশেপাশের অনেক কৃষকও এই একই সমস্যায় ভুগছিলেন। 

গত শনিবার থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। শনিবার (২৯ জুন) ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। রোববার ৩০ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। সোমবার রাজশাহীতে ৩৩মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে রাজশাহী আবহাওয়া অফিস।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম বলেন, এবছর বেশ কয়েকদিন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত হলেও রাজশাহীতে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। আষাঢ় মাসে দেখা মিললেও ছিলো না কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির। তবে শেষ পর্যন্ত মৌসুমি বায়ু প্রবেশের কারণে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো আজ রাজশাহীতেও বৃষ্টি হয়েছে। এখনও বৃষ্টির আভাস আছে, রাতেও বৃষ্টি হতে পারে। আরও কয়েকদিন থাকতে পারে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছর জেলায় ৫০ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে আউশ ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু গত দুই মাসে মাত্র ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে আউশের চারা রোপণ করা সম্ভব হয়েছে। এদিকে, আগামী এক মাসের মধ্যে শুরু হবে আমন ধান চাষ। কিন্তু রাজশাহীতে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় আমন ধানের বীজতলাও প্রস্তুতেও শঙ্কা তৈরি হয়েছিল।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) উম্মে সালমা বলেন, রাজশাহীতে এবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কম। ফলে বৃষ্টির অভাবে মাঠ-ঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাওয়ায় ধানচাষ ব্যাহত হচ্ছিলো। তবে রোববারের মুসলধারের বৃষ্টি অন্য ফসল তো বটেই, বিশেষ করে আউশ-আমনের জন্য আশীর্বাদের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর