কয়েক দফা উচ্ছেদেও বেদখল রামচন্দ্রপুর খাল

, জাতীয়

রুহুল আমিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-10-03 14:25:02

রাজধানীর মোহাম্মদপুর ভাঙা মসজিদ এলাকার এক নম্বর সড়ক ঘেঁষে অবস্থান রামচন্দ্রপুর খালের। সেই খালের একটা বড় অংশ দখল করে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসাইন। টিনশেডের ছাউনি দিয়ে সেখানে প্রায় কয়েক হাজার দেশি-বিদেশি গরুর খামার গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

ইমরান হোসাইনের অবৈধভাবে গড়ে তুলা সে সাম্রাজ্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় এক ছাগলকাণ্ড। গত ঈদুল আযহায় ১২ লাখ টাকার এক ছাগলকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী শুরু হয় নানা আলোচনা, সমালোচনা। এর জের ধরে খালে থাকা সাদিক এগ্রোর একটি অংশ ভেঙে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। দখলমুক্ত করা হয় খালের অংশটুকু।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেখানে অফিস তুলে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা। সে খবর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে উচ্ছেদ অভিযান চালায় বিএনপি। সেসময় নিজেরাই অফিসটি তুলে নেয় দলটির নেতাকর্মীরা। উচ্ছেদ করা হয় অন্যান্য দখলকারীদেরও। এরপর এক মাসেরও কম সময়ে আবারও দখল হতে দেখা গেল খালটি।

কয়েক দফা উচ্ছেদের পরও আবার বেদখল হচ্ছে রামচন্দ্রপুর খাল

সরেজমিনে বুধবার (২ অক্টোবর) দুপুরে রামচন্দ্রপুর খালের দখল হয়ে যাওয়া অংশে গিয়ে দেখা যায়, ক’দিন আগেই এই অংশটি যে দখলমুক্ত করা হয়েছে তা বুঝার আর উপায় নেই। এটি যে কখনো খাল ছিল সে অস্তিত্বও এখন বিলীন। খালটি সড়ক সমান উঁচু করে প্রায় ১৫-২০ ফুট মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। সেখানে গড়ে উঠছে রিকশাগ্যারেজ ও বসতঘর।

এদিন দেখা যায়, বসতভিটাহীন কিছু মানুষ অস্থায়ীভাবে বাঁশ, টিন ও তেরপাল ব্যবহার করে গরে তুলেছেন বেশ কয়েকটি ঘর। এছাড়াও আয়োজন চলছে আরও বেশ কয়েকটি ঘর নির্মাণের। সেজন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ঘরের অবয়ব। এছাড়াও তোড়জোড় চলছে রিকশা গ্যারেজ বানানোর। এখনো কোন গ্যারেজ গড়ে না উঠলেও পার্ক করে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটি রিকশাভ্যানও।

উচ্ছেদের পরও নতুন করে তৈরি করা হয়েছে টিনের ঘর

এখান থেকে আধা কাঁচা-পাকা রাস্তা পার হয়ে একটু সামনে গেলেই দেখা মেলে সাদিক এগ্রোর নিজস্ব ভবনটির। সেখানে টিনশেড ঘরে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটি দেশি-বিদেশি গরু। বিশালদেহী এসব গরু আগামী ঈদুল আযহার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হচ্ছে। তবে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কথা বলার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি।

এসময় চার বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছিলেন সাদিক এগ্রোর দেয়ালের পাশ ঘেঁষে। গরুর খামারটির বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তারা বলেন, সামনের পুরোটা জুড়েই খামার ছিল। পিছনে আরও ছিল। নবীনগর হাউজিংয়েও আছে। কয়েকমাস আগে সরকার ভেঙে দিলে এখানে নতুন করে আর কিছু বানায়নি।

রামচন্দ্রপুরের খালের যে অংশটি ভাড়া নিয়ে খামার গড়ে তুলেছিল সাদিক এগ্রো সেখানে এখন দেয়াল তুলছেন জমির মালিকরা। দুপুরে সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে তখন তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে কাজ করতে দেখা যায় কয়েকজন শ্রমিককে। একজন বালুর সাথে সিমেন্টের মিশ্রণ করছিলেন, আরেকজন সেটা নিয়ে যাচ্ছিলেন মূল মিস্ত্রির কাছে। সেই সিমেন্টে মাখা বালি দিয়ে ইটের পর ইট গেঁথে গড়ে তুলছিলেন দেয়াল।

সেই মিস্ত্রিদের একজনের সঙ্গে কথা হয় বার্তা২৪.কমের। নিজের নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ‘আমরারে সকাল বেলা নিয়া আইছে। আমরা মালিকরে চিনি না। সকাল থেকে ১১টা পর্যন্ত একজন ছিল, সে আমাদের কাজ দেখায় দিছে, আমরা কাজ করতেছি। মালিকের নামও আমরা জানি না। কাল কাজ করতে বলবে কিনা সেটাও জানি না। বললে আসবো, না হয় আসবো না’।

খালের মাঝ বরাবর ধরে ছোট ছোট কাপড়ের টুকরো, রশি দিয়ে বাঁশের সাথে বাঁশ বেঁধে ঘর বানাচ্ছিলেন আব্দুল আলীম (ছদ্মনাম)। নিজের বলতে কিছু নেই তার। এই সরকারি জমিতে পুরাতন বাঁশ, টিন আর কাগজ দিয়ে বানানো ঘরই তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। কয়েক মাস আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সাদিক এগ্রোর সঙ্গে ভাঙা হয় তার ঘরটিও। সে জন্য তার রাগ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। তবে সে নিয়ে কারো কাছে অভিযোগ দেবে না, সব কথা তার সৃষ্টিকর্তার সাথে। তাই বিচার চান একমাত্র সৃষ্টিকর্তার কাছেই।

ক্ষোভ যে শুধু সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ওপর তা নয়, সরকারি খালের উপর বানানো তার এই ছোট্ট ঘরেও হামলে পড়ে এলাকার মাদকাসক্তরা। তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে করে মাদক সেবন। নিয়ে যায় টাকা পয়সা ও মোবাইল। সে বিচারও তার সৃষ্টিকর্তার কাছে। টাকা-পয়সাহীন সত্তোরোর্ধ্ব আব্দুল আলীমের কথা শোনার মতো কেউ নাই যে এই ব্রহ্মাণ্ডে।

সেই ক্ষোভ থেকেই আব্দুল আলীম বলেন, ‘আইছে আর ঠাস কইরা আমার ঘরটা ভাইঙা দিছে। আমি বার বার কইরা কইছি, ভাইঙেন না। আমিই আস্তে আস্তে ঘর সরাই নিমু। কিন্তু আমারে গালি দিয়া কয়, সরেন। আমরা এখনই ভাঙমু, এই কইয়া লগে লগেই ভাইঙা দিলো আমার ঘরটা। আমি একলা মানুষ। এই সময়ে ঘর থাইকা আর কি বাইর করতারি’।

এই সব জমি ও ঘরহীন মানুষদের আশ্রয়স্থল এই খাল হলেও ভরাট করা এই সব খালের বড় সুফল নিয়ে যায় প্রভাবশালীরা। সেখানে ব্যবসা হয়, ঘর হয়, গ্যারেজ হয়, দোকান হয়। এই সব স্থাপনা থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে পুরে সে সব প্রভাবশালীরা। সেই টাকায় প্রভাবশালীরা হয়ে উঠে আরও প্রভাবশালী। দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে আবারও হামলে পড়ে সরকারি সম্পত্তিতে, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে পকেট ভারি করে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।

উচ্ছেদ করার কয়েক মাসের মধ্যেই দখল হয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে দখল যেন না হয় সে জন্য কী ব্যবস্থা নেবেন এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মীর খায়রুল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আপনারা তো বাংলাদেশের পরিবেশ জানেন। মাঝে বেশ কিছুদিন আমরা কাজ করতে পারিনি। এখন দখল হয়ে গেলে আমরা আবারও উচ্ছেদ করব। উচ্ছেদ করে খাল খনন করার প্রকল্প গ্রহণ করব।

এ সম্পর্কিত আরও খবর