জলবায়ু পরিবর্তন: হাতে সময় মোটে ৫ বছর!

ঢাকা, জাতীয়

বার্তা২৪ স্পেশাল রিপোর্ট | 2023-08-31 09:32:44

কথা নয়, কাজে বিশ্বাসী, এই আপ্তবাক্যটি আর যেখানেই খাটুক না কেন, জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুটির সঙ্গে আর খাটবে না। গোটা বিশ্ব জানে, গত অন্তত তিনটি দশক এ নিয়ে কথাই বেশি হয়েছে। কাজ হয়েছে খুবই সামান্য।

আর তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রহ্মাণ্ড এখন যে পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছে, বিশেষত কার্বন নিঃসরণের যে পরিসংখ্যান আজ দেখানো হচ্ছে, তাতে বলা হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলে এতটা কার্বনের উপস্থিতি ১২ মিলিয়ন বছর আগেও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় গেল মাসের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত এক জলবায়ু সম্মেলনে কথাটি স্পষ্ট করে উচ্চারণ করলেন এক হার্ভার্ড বিজ্ঞানী। তিনি সাফ সাফ বলে দিলেন, এই গতিতে চললে ব্রহ্মাণ্ডকে ৩৩ মিলিয়ন বছর আগের সেই ইয়োসিন যুগে (প্রস্তর যুগের দ্বিতীয় ভাগ যা ৬৬ মিলিয়ন থেকে ২৩ মিলিয়ন বছর আগের সময়টিকেই নির্দেশ করে) নিয়ে যাবে। আর সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণে হাতে সময় রয়েছে মোটে পাঁচ বছর।

কথায় কথায় একটি কথাতো খুব বলা হয়, বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই যা করার তা করতে হবে। কিন্তু হার্ভার্ড বিজ্ঞানীর কথায় মনে হচ্ছে, দেরি বুঝি হয়েই গেল। ফোর্বস ম্যাগাজিন হার্ভার্ড অধ্যাপক জেমস এন্ডারসনের কথাগুলোকে খুব গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। তাতে এন্ডারসনকে উদ্ধৃত করা হয়েছে এভাবে- ‘প্রকৃত অবস্থা কী তা নিয়ে আমাদের কাছে এখন পাক্কা তথ্য, তত্ত্ব আর উপাত্ত রয়েছে। আমরা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগের সেই প্রস্তর যুগের আবহাওয়া মণ্ডলেই ফেরত যাচ্ছি, যেখানে দুই মেরুর কোথাও কোনো বরফের অস্তিত্ব থাকবে না। আর বিষুবরেখা ও মেরুরেখার আবহাওয়ায় থাকবে না কোনো ভিন্নতা।’

ক্লোরো-ফ্লোরো-কার্বনে ওজন স্তর ছিদ্র হয়ে অকেজো হয়ে পড়ছে- এমন তত্ত্ব এনে এবং তা প্রমাণ করে অনেক আগেই বিশ্বজুড়ে নাম কুঁড়িয়েছেন এই বায়ুমণ্ডলীয় রসায়নবিদ। ফোর্বস ম্যাগাজিন লিখেছে, গত ১৩ জুন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই আলোচনায় জেমস এন্ডারসন আরও বলেন, ‘ঠিক আজ যতটুকু, তার চেয়ে ১০ সেন্টিগ্রেড উষ্ণতায় বইবে সমুদ্রের পানি। সমুদ্র তলদেশের পানির তাপমাত্রায়ও থাকবে না এমন কিছু ভিন্নতা। আর বাতাসে জলীয়বাষ্প যে হারে বেড়ে যাবে, তাতে ঝড়-ঝঞ্ঝা হয়ে উঠবে এক অনিবার্য পরিণতি। পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলীয়বাষ্পে যে গ্যাসের সৃষ্টি হয়, তা ঝড়-ঝঞ্ঝার পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রভাবিত করবে।’

এন্ডারসন বলেন, ‘স্রেফ কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আমরা এই পরিণতি থেকে রেহাই পেয়ে যাব- এমন এক ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মধ্যে কাজ করছে। তবে পরিত্রাণ যে একেবারেই অসম্ভব, তা নয়। সে জন্য আমাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী শিল্পবিপ্লবের মতোই কিছু একটা করতে হবে। কার্বন দূষণ বন্ধতো করতেই হবে, একই সঙ্গে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন সরিয়ে ফেলতে হবে। তাতে যদি ওজন স্তর কিছুটা রক্ষা পায়, আর সূর্যের নীল রশ্মিগুলো সেই স্তরের ওপর পড়ে আবার মহাকাশমণ্ডলেই ফিরে যেতে পারে। আর সে জন্য আমাদের হাতে রয়েছে মোটে পাঁচটি বছর।’

আরও যেসব ভয়াবহ তথ্য অধ্যাপক জেমস এন্ডারসন দিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ২০২২ সাল নাগাদ আর্কটিকে আর একটিও স্থায়ী বরফখণ্ডের অস্তিত্ব থাকবে না। গেল ৩৫ বছরে এই অঞ্চলের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ স্থায়ী বরফখণ্ড গলে যেতে শুরু করেছে।

আমরা যদি ভেবে থাকি, ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ স্থায়ী বরফ গলতে শুরু করার পরেও আমাদের পরিণতি ভালো কিছু হবে, তা হলে কী আমরা সঠিক ভাবছি? প্রশ্ন ছিল জেমন এন্ডারসনের। আর উত্তরটিও তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, না।

এই বড় ‘না’ কথাটি আবার প্রধান দু’টি কারণে। প্রথমটির নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন পুনঃপ্রত্যবর্তন। আসলে এই বিশ্ব উষ্ণায়নে আমাদের ধরিত্রী নিজেই এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে প্রস্তুত। যার অন্যতম হচ্ছে-স্থায়ী বরফাচ্ছন্ন অংশের এবং সমুদ্র তলদেশে যে ভয়াবহ মিথাইন গ্যাস জমাট বেঁধে আছে সেগুলো যে কোনও সময় ছিঁটকে বেরিয়ে আসবে। এতে উষ্ণায়ন তরান্বিতই হবে। অন্যটি হচ্ছে, গ্রিনল্যান্ডের বিপুলকায় বরফখণ্ডটি। যা বেশ আগে থেকেই ভেঙ্গে পড়ি পড়ি করছে। কিন্তু এখনো ভাঙ্গেনি। একবার ভেঙ্গে পড়লে সমুদ্রে পানির স্তর যে বেড়ে যাবে সে কথা বলাই বাহুল্য। অধ্যাপক এন্ডারসন জানাচ্ছিলেন, শুধু বাড়বে বললে কম বলা হবে। কারণ তখন অন্তত সাত মিটার উচ্চতায় বইবে সমুদ্রের পানি। ফুটের হিসাবে যা ২৩ ফুট।

এই যে সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাবে বলে পই পই করে বলা হচ্ছে, মানুষ আসলে তার ভয়াবহতা কতটুকু অনুধাবন করতে পারছে? সে প্রশ্নটিই করলেন হার্ভার্ড অধ্যাপক। তিনি অবশ্য কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। আর সে কারণে একটু সপ্রমাণ উপাত্ত হাজির করলেন তার আলোচনায়। একটি ম্যাপ ডিসপ্লে করে দেখিয়ে দিলেন, এই যে ১০ বিলিয়ন ডলারে নির্মিত হার্ভার্ড ক্যাম্পাসে বসে আমরা কথা বলছি, সেটি সমুদ্র পৃষ্ঠের মোটে তিন মিটার উপরে। ফলে সাত মিটার উচ্চতায় সমুদ্র স্তর এর কি পরিণতি ঘটাবে তা বলাই বাহুল্য। ওদিকে ম্যানহাটান ততক্ষণে পানির দখলে চলে যাবে, আর ফ্লোরিডার দক্ষিণাংশ পুরোপুরি অস্তিত্ব হারাবে।

এখানে জানিয়ে রাখি, আমাদের ঢাকার উচ্চতা সমুদ্র থেকে চার মিটার উপরে। দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল মাত্র ১.২ মিটার উপরে।

‘এসব তথ্য উপাত্ত নিয়ে আপনি যখন কাজ করবেন, তখন রাতে ঘুমাতে পারবেন না। তখন আপনার মগজে এসে হানা দেবে নৈতিক দায়িত্ববোধ,’ বলেন অধ্যাপক জেমস এন্ডারসন। ১৯৮৭ সালে এই কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে এনে ওজন স্তরের ধ্বংস ঠেকানোর যে মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা সম্ভব করে তুলতে এই হার্ভার্ড অধ্যাপকের বড় ভূমিকা ছিল। সে জন্য ২০১৬ সালে শিকাগোয় তিনি বেনটন মেডাল ফর ডিস্টিংগুইশড পাবলিক সার্ভিস পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

তবে পুরস্কারই শেষ কথা নয়। এন্ডারসন বলেন, ‘এখন পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে বিষয়টি আমাদের পদার্থবিজ্ঞানীদের সেভাবে দায়িত্ব নিতে হবে, ঠিক যেভাবে আমাদের জীববিজ্ঞানীরা ক্যান্সার প্রতিরোধে লড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদার্থবিদ্যার শিক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরকারের নীতি কৌশল, জননীতি ও অন্যান্য বিষয়গুলো সম্পৃক্ত করতে হবে।’

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সে আয়োজনে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও একচোট নিলেন এই অধ্যাপক। বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধে রাজি নয়। রাজনৈতিক নেতারা তো যখন তখন এর পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছেন। জীবাশ্ম জ্বালানির বেনিয়ারা তো নানাভাবেই তা চালু রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর সাংবাদিকরাও তাদের বক্তব্য ভুল প্রমাণে যথার্থ তথ্য-উপাত্ত হাজির করতে পারছে না।’

‘আমি বুঝি না এই লোকগুলো তাদের শিশুদের পাশে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসেন কীভাবে, উদ্বেগ ঝরে এন্ডারসনের কণ্ঠে। ‘লোকগুলো তো অশিক্ষিত কিংবা নির্বোধ নয়,’ বলেন তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর