জামায়াতের প্রধান কার্যালয় এলাকাবাসীর কাছে এখন ‘ভুতের বাড়ি’

, রাজনীতি

অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-07-30 17:18:11

রাজধানীর বড় মগবাজার রেলগেট পার হয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলে বাম পাশ দিয়ে একটি গলির দেখা মিলে। ব্যাপারী গলি হিসেবে খ্যাত এই গলিটিতেই এক সময় কর্মচঞ্চল পদচারণায় মুখরিত থাকতো মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে অস্ত্র ধরা দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নেতাকর্মীদের আনাগোনায়।

ব্যাপারী গলিতে প্রবেশ করতেই দেখা মিলবে সড়কের গাঁ ঘেঁষে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা ৪ তলা বিশিষ্ট ঘি রঙয়ের পুরাতন একটি ভবন। এই ভবনটিই মূলত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলের প্রধান কার্যালয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মানবতাবিরোধী অপরাধে যখন থেকে জামায়াত নেতারা গ্রেফতার হতে থাকেন, তখন থেকে তাদের কার্যালয়ের প্রধান গেটে ঝুলে যায় তালা। বছরের পর বছর ধরে খুলছে না ঝুলে থাকা তালা। অনেকটা মরীচিকার দখলে চলে গেছে প্রধান গেটসহ গেটে ঝুলে থাকা তালা। লতাপাতায়ও বেঁধেছে বাসা। তবে ভেতরে অবস্থান করছেন প্রহরীরা। শিফটিং (পরিবর্তন) ভিত্তিতে চলছে তাদের নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ। দেখা নেই কোন নেতাকর্মী ও দলীয় কর্মযজ্ঞের। ফলে দীর্ঘ সময় অব্যবহৃত জরাজীর্ণ এই ভবনটি এখন স্থানীয়দের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে ‘ভুতের বাড়ি’ হিসেবে।

মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) রাজধানীর পুরাতন এলিফ্যান্ট রোড বড় মগবাজার রেলগেট সংলগ্ন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কার্যালয় ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

ভবনটির সামনে অবস্থিত ডেইলি মিল্ক এন্ড মিল্ক প্রোডাক্টস এর মালিক স্বপন বার্তা২৪.কমকে বলেন, দীর্ঘদিন এই কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। প্রায় ১৪-১৫ বছর তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। এখন ‘ভুতের বাড়ি’ হয়ে গেছে এটা। মানুষ ভুতের বাড়ি বললেই চেনে।


তিনি বলেন, আমি ১০ বছর এই এলাকাতে ব্যবসা করছি। যখন থেকে বিচার কাজ শুরু হয়েছে, নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে, তারপর থেকে এখানে আর কেউ আসেনি। তখন থেকেই বন্ধ পড়ে আছে। যখন তাদের দলীয় কার্যক্রম চালু ছিল তখন আশেপাশে অনেকেই ভাড়া থাকতো। তারাও কেউ নেই এখন, সবাই বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। আবার এই মসজিদে অনেকেই তারা নামাজ পড়তো। এখন তাদের একজনকেও মসজিদে দেখি না।

মায়ের আশীর্বাদ বিরিয়ানি এন্ড ক্যাটারিং হাউজ-এর কর্মচারী রায়হান বার্তা২৪.কমকে বলেন, এই কার্যালয় বন্ধ পড়ে আছে। আমি এখানে একমাস হলো কাজ শুরু করেছি, এর মাঝে কখনও একবারের জন্যও গেট খোলা বা কারোর যাতায়াত দেখিনি। তবে ভেতরে কয়েকজন থাকেন, তারা এই ভবন পাহারা দেয়।

রায়হানের কথার সূত্র ধরে ভেতরে পাহারাদারদের উপস্থিতির সন্ধান চালায় বার্তা ২৪.কম। এরপর দেখা মেলে ছোট একটি গেটের। সেখানে নক করতেই টি-শার্ট ও লুঙ্গি পরিহিত একজন এসে খুলে দেন গেট। ভেতরে ঢুকতেই দেখা মেলে একটি চেয়ার ও টেবিলে বসে সংবাদপত্র পড়ায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। অন্য একজনের দেখা মেলে গোসল করতে।

এদিকে ভবনের নিচে পড়ে থাকতে দেখা গেছে পরিত্যক্ত টেবিল চেয়ারের স্তূপ। অন্য পাশেই রয়েছে ভাঙাচুরা ইট মাটি ও ময়লার স্তূপ। তার পাশে অবস্থিত দেয়াল বেয়ে উঠেছে করলা গাছ। যেটা বয়ে চলেছে প্রধান গেটের উপর দিয়ে। এই করলা গাছটি প্রমাণ দিচ্ছে কার্যালয়টির প্রধান ফটকের গেটটি এখন সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর।

নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্বে থাকা জাহাঙ্গীর আলম বার্তা ২৪.কমকে বলেন, আমাদের কার্যালয়টি ২০১১ সাল থেকে বন্ধ পড়ে আছে। তারপর থেকে আর খোলা পড়েনি। আমরা গার্ডরা এখানে থাকি, আর কেউ থাকে না। আমরা মোট ৭ জন আছি। দুইজন দুইজন করে শিফটিং করে ডিউটি করি।

কার্যালয় বন্ধ, কিন্তু আপনারা দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন। তাহলে আপনাদের বেতন ভাতা কিভাবে, কে দেয় প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট থেকে আমাদের বেতন দেয়।

অন্য নিরাপত্তারক্ষী আজাদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, এই চারতলা ভবন সম্পূর্ণটায় সারা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর প্রধান কার্যালয়। এখানে কেউ আসে না। আমাদেরও কোন কাজকর্ম নেই। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকি।

এদিকে জামায়াত-শিবিরকে আগামীকাল বুধবারের (৩১ জুলাই) মধ্যে নিষিদ্ধ করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এটি করা হবে বলেও তিনি জানান। মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বলেন তিনি। আইনমন্ত্রী বলেন, “নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া ঠিক করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসব।”

এর আগে সোমবার ১৪ দলের বৈঠকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নেওয়া হয়। ওইদিন রাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

১৪ দল মনে করে, সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে যে সন্ত্রাস এবং নাশকতা হয়েছে এর পেছনে জামায়াত-শিবির কলকাঠি নেড়েছে। ১৭ জুলাই থেকে ঢাকায় যে সন্ত্রাসী তাণ্ডব হয়েছে এর মূল কারিগর ছিল জামায়াত-শিবির।

বৈঠকে ১৪ দলের নেতারা অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচার হয়েছে। এছাড়া সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নির্বাচন কমিশন যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে সেজন্য এখন আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সময় এসেছে। কারণ একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী যে চরিত্র তা এখনো বদলায়নি।

বৈঠকে ১৪ দলের নেতারা জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মতি দেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব ১৪ দলের বৈঠকে পাস হয়।

উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনলে ৩৮টি দলের সঙ্গে সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকা জামায়াতে ইসলামীও নিবন্ধিত হয়। আইন অনুযায়ী শুধু নিবন্ধিত দলগুলোই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এরপর তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে জামায়াতকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন।

ওই রিটের প্রেক্ষিতে জারি করা রুলের শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের বেঞ্চ জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রায় দেন। রায়ে সংবিধানের সঙ্গে দলটির গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়।

এরপর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে, যা গত বছরের ১৯ নভেম্বর খারিজ হয়ে যায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর