জানিদোস্ত যখন দুশমন, তখন হিংসে ম্যাচ জেতে

ক্রিকেট, খেলা

বার্তা২৪ স্পোর্টস | 2023-09-28 20:28:50

অনেক কিছুই বলেছেন সাকিব আল হাসান। তার মধ্যে দুটি অভিযোগ খুবই পরিষ্কার। 

১) ‘তামিম বাচ্চামি আচরণ করছেন’। 

২) ‘তামিম টিম ম্যান না’!

সত্যিই কি তাই?

১৭ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলা একজন ক্রিকেটার, যিনি কিছুদিন আগেও অধিনায়ক ছিলেন; তার বিরুদ্ধে বর্তমান অধিনায়কের এমন অভিযোগ কি মানানসই কোনো কথা!

এই তামিম-সাকিব ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে জানপ্রাণ মার্কা বন্ধু ছিলেন। যাকে বলে হরিহর আত্মা, ঠিক তাই। বিদেশ ভ্রমণে দুজনে একই রুমে থাকতেন। বিমান পাশাপাশি আসনের জন্য আবদার জুড়তেন। হোটেলে খেতেও যেতেন একসঙ্গে। সেই সময় একজন ছিলেন দলের অধিনায়ক এবং আরেকজন সহ-অধিনায়ক। 

সেই সম্পর্ক ভেঙে গেছে। এখন দুজনের কথা বলা বন্ধ। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় প্রমাণিত সত্য যে দুজনের মধ্যে চরম বৈরিতা বিরাজমান। যার বিস্ফোরণ ঘটলো তামিমের ভিডিও বার্তা এবং সাকিবের টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে। বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়া নিয়ে তামিম তার ভিডিও বার্তায় কারো নাম ধরে কোনো অভিযোগ করেননি। কিন্তু সাকিব তার সাক্ষাৎকারে তামিমের প্রসঙ্গে কোনো রাখঢাক না করে তার বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ এনে দাড় করিয়েছেন। এই কিছুদিন আগেও যার সঙ্গে তিনি একই ড্রেসিংরুমে ছিলেন। মাঠে লড়েছেন একসঙ্গে। সেই তার বিরুদ্ধেই সাকিব এখন অভিযোগের ঝাঁপি খুলে দিয়েছেন। 

তামিমের ভিডিও বার্তা এবং সাকিবের ঝাঁঝালো মন্তব্য-এই দুইকে যোগ করলে যে দৃশ্য মিলছে তার সঙ্গে কলপাড়ায় কলস হাতে গলার রগ ফুলিয়ে ঝগড়াঝাঁটির একটা সাযুজ্য পাওয়া যাচ্ছে। 

আর তাই আপনিই বলতেই পারেন, দিস ইজ নট ক্রিকেট! 

একসময়কার জানিদোস্ত দুজন যেভাবে কুঁদে নেমেছেন সেটা পাবলিক হাসাচ্ছে। ক্রিকেট এবং সম্পর্কের মর্যাদায় কালি ছিটাচ্ছে। 

ভাঙ্গা হাত নিয়ে যে ক্রিকেটার দলের ইনিংস বড় করতে একহাতে ব্যাট করতে পারেন তাকে যদি ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে এসে শুনতে হয় তিনি টিম ম্যান না! তখন তার সত্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজন পড়ে না। বরং যিনি অভিযোগটা করেছেন তার হিংসুটেপনা আচরণই বেশি প্রমাণিত সত্য তখন। 

একটু পেছনে ফিরে যাই। এশিয়া কাপ ক্রিকেট। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সাল। দুবাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে খেলছে বাংলাদেশ। তামিম ইকবাল সেই ম্যাচের শুরুর দিকে সুরঙ্গা লাকমলের বাউন্সারে বাম হাতের কব্জিতে চোট পান। মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। খানিকবাদে চিকিৎসক জানিয়ে দেন এশিয়া কাপে তার আর খেলা হচ্ছে না। খানিক আগে বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্টও জানিয়ে দেয় এই ম্যাচের বাকি সময় তামিম ইকবাল ব্যাট করতে পারবেন না! হাসপাতাল ঘুরে এসে তামিম ড্রেসিংরুমের সামনে বসে দলের ব্যাটিং দেখছিলেন, হাতে তখন ব্যান্ডেজের স্লিং। দেশে ফিরে আসার কথা তার পরদিন ১৬ সেপ্টেম্বরের ফ্লাইট ধরে। 

সবাই যখন ধরে নিয়েছে তামিম ইকবালের এশিয়া কাপ শেষ! ঠিক তখনই তামিম ইকবাল যা করলেন সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন এক বীরত্বগাঁথার জন্ম দিল। 

ভাঙা হাত নিয়েই তামিম ইকবাল নেমে পড়লেন ব্যাটিংয়ে। দেশের স্বার্থ যে সবার আগে! মুস্তাফিজ রান আউট হতে সবাই যখন বাংলাদেশ ২২৯ রানে অলআউট এই হিসেব কষছিলেন তখন তামিম ইকবাল বদলে দিলেন সেই সমীকরণ।

এবং হ্যাঁ, কি আশ্চর্য কোন রান না করেই! ইনজুরিতে কাহিল হাতটা বুকের সঙ্গে চেপে অন্য হাতে ব্যাট ধরে মাত্র ১ বল খেলেই তামিম ইকবাল যা করলেন সেটাই যে এই ম্যাচে বাংলাদেশকে সামনে বাড়ার সবচেয়ে বড় শক্তি যোগাল!

মাঠ-গ্যালারির সবাইকে তো বটেই, এমনকি ড্রেসিংরুমে নিজ সতীর্থদেরকেও অবাক করে তামিম ইকবাল ম্যাচে ব্যাট করতে নেমে গেলেন! দলের দুঃসময়ে এভাবেই যে দাড়াতে হয় বীর! একহাতে ব্যাটের হাতল ধরে ব্যাট করলেন! একেই বলে সাহস। একেই বলে দেশের হয়ে খেলা। একেই বলে দেশের জন্য ভালবাসা। জানবাজি! ক্রিকেটীয় সাহসের নতুন একটা উদাহরণ তৈরি করলেন তামিম ইকবাল। যে হাতে ব্যাথা ছিল সেই হাতে ব্যাট ধরলেন না। ধরলেন ডান হাতে শুধু ব্যাটের উপরের হাতল। সেভাবেই ব্যাট করে গেলেন। মুশফিকুর রহিমকে সঙ্গ দিলেন! 

নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে মুস্তাফিজুর রহমান যখন আউট হলেন তখনো বাংলাদেশের ইনিংসে ১৯ বল বাকি! স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশের জমা হয়েছে ২২৯ রান। ধারাভাষ্যকারও বলে ফেললেন বাংলাদেশের ইনিংস শেষ ২২৯ রানে! কিন্তু খানিকবাদে ধারাভাষ্যকারও বিস্ময়ের সুরে জানালেন-তামিম ইকবাল ব্যাট করতে মাঠে নামছেন! তামিম ইকবাল যখন ব্যাট করতে নামলেন তখনো সেই ওভারে সুরঙ্গা লাকমলের একটি বল বাকি। সেই বল তামিম একহাতে ব্যাট চালিয়ে খেললেন। লেগ সাইডে বল ঠেললেন। কিন্তু কোন রান নিলেন না। তামিমকে বাকি সময়টা আগলে রাখেন মুশফিক। আর কোন বলে তামিমকে যাতে স্ট্রাইকে থাকতে না হয়-সেই কৌশল নিয়ে খেলে যান মুশফিক। কোন সিঙ্গেল নেননি। বাউন্ডারি ছাড়া দৌড়াননি। ওভারের শেষ বলে সিঙ্গেলস নিয়ে স্ট্রাইকটা নিজের হাতেই রাখেন মুশফিক! একহাতে ব্যাট ধরে ইনজুরিতে থাকা বামহাত তামিম বুকের সঙ্গে লাগিয়ে খেলে যান। অবিশ্বাস্য নিবেদন!

তামিমের সঙ্গে মুশফিকের শেষের এই জুটিতে রান উঠে ৩২। তামিম খেলেন মাত্র একটি বল। শেষের এই জুটিতে ১৬ বলের মধ্যে ১৫ বলে মুশফিক তিনটি বাউন্ডারি ও তিনটা ছক্কা হাঁকান। চোখের নিমিষেই দলের স্কোর ২২৯ থেকে পৌছায় ২৬১ রানে। মুশফিকের ব্যাট হাসল ১৪৪ রানের অনবদ্য সেঞ্চুরির আলোয়। শেষের এই ১৬ বলের মধ্যে তামিম মাত্র একটি বল খেলেন। কোন রান করেননি। কিন্তু তার এই যে একহাতে ব্যাট করতে নামার জেদ- দলকে ভাল অবস্থানে পৌছে দিতে পারার যে দুর্বিনীত চেষ্টা; শক্তির শেষ বিন্দু উজাড় করে দেয়ার যে চোয়ালশক্ত দৃঢ়তা-এই ম্যাচে জয়ের মন্ত্র তো সেখান থেকেই পেল বাংলাদেশ। 

শেষের এই লড়াইয়ে কোন রান করেননি তামিম। খেলেছেন মাত্র এক বল। রান শুন্য। কিন্তু শূন্যের শক্তিও যে অপরিসীম হয়-এই ম্যাচে তামিমের লড়াই সেই প্রমানই রাখল!

ওই ম্যাচে এক বল খেলে শূন্য রান করা সাকিবও সেদিন তামিমের সেই বীরত্বগাঁথা দেখেছিলেন। সেই তামিমকে আজ সাকিব বলছেন- ‘ও তো টিম ম্যান না।’

সাকিবের এই অভিযোগ যে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে তার নাম হিংসা, ঈর্ষা!

এ সম্পর্কিত আরও খবর