কেউ বলছেন তদন্ত কমিটি। কেউ ডাকছেন ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। বিসিবি তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই কমিটিকে অভিহিত করেছিল এই নামে- ‘তিন সদস্যের বিশেষ কমিটি’। এই কমিটির মূল কাজ কী ছিল সেটাও বিসিবির ২৯ নভেম্বরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ঠ করে লেখা।
কী সেটা জানি আগে।
তিন সদস্যের এই কমিটির উদ্দেশ্য, তারা এই টুর্নামেন্টে (২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ) দলের দুর্বল পারফরম্যান্সের পেছনের মূল কারণগুলো যাচাই করবে এবং এটি পরবর্তীতে বোর্ডের কাছে ফলাফল উপস্থাপন করবে।
সেই কাজ একটু দেরিতে হলেও তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি সেরে ফেলেছে। কমিটি সংশ্লিষ্ঠ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে। এই তালিকায় বিশ্বকাপে খেলা ক্রিকেটাররা রয়েছেন। টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন রয়েছেন। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে এবং অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের সঙ্গেও কমিটি কথা বলেছে।
বিশ্বকাপে খেলেননি কিন্তু বিশ্বকাপের আগে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনায় ছিলেন এবং বিশ্বকাপের দলে তাকে না রাখতে যিনি নির্বাচকদের কাছে ফোন করেছিলেন সেই ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সঙ্গেও বিসিবির বিশেষ কমিটি কথাবার্তা বলেছে।
তামিমের সঙ্গে তাদের এই কথোপকথনের বিষয়টিতেই নিশ্চিত যে বিশ্বকাপের মাঠে নামার আগে সমস্যায় পড়েছিল বাংলাদেশ। তামিম হঠাৎ করে কোন জটিলতায় পড়ে নিজেকে বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন? সেই প্রশ্নের উত্তর কি খুঁজে পেয়েছে এই বিশেষ কমিটি? বিশ্বকাপের দলের জন্য কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ও অধিনায়ক সাকিব আল হাসান যা চেয়েছিলেন তাই তো পেয়েছিলেন। বিশ্বকাপে ব্যর্থতার জন্য কোচ ও অধিনায়কের ভুল সিদ্ধান্তগুলো কি বিশেষ কমিটির রিপোর্টে রয়েছে? সাকিব-তামিমের দ্বন্দ্ব, প্রকাশ্যে একে-অন্যের ময়লা ঝাড়ার বাজে উদাহরণ, আচরণের কুপ্রভাব নিয়েই বিশ্বকাপে খেলতে যায় বাংলাদেশ। একটা বৈশ্বিক আসরে খেলতে যাওয়ার আগে দেশের দুই তারকা ক্রিকেটার কেন এমন অসামাজিক আচরণ করে পুরো আনন্দময় আয়োজনকে আগেভাগে সৎকার করে দিলেন? বিশেষ কমিটি কি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছে?
বিসিবির বিশেষ কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে গত মাসে। কিন্তু বিসিবি সেই রিপোর্ট নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তবে সংবাদ মাধ্যমে সেই রিপোর্টে কি আছে তা নিয়ে গরম খবর বেরিয়েছে। তাতেই উত্তাপ দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে।
সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, বিশ্বকাপের ব্যর্থতার জন্য অন্তত দুজন বোর্ড পরিচালককে অভিযুক্ত করে ক্রিকেটাররা কথা বলেছেন। সেই দুজন বোর্ড পরিচালক কারা, তাদের নাম অবশ্য উল্লেখ নেই। কিন্তু এই দুজন কে- সেটা খুঁজতে নিশ্চয়ই আরেকটি তদন্ত কমিটির প্রয়োজন হবে না।
যেহেতু বিশেষ কমিটির রিপোর্টে বোর্ড পরিচালকদের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাই এই রিপোর্ট বোর্ডের পরিচালকদের কাছে নয়, শুধুমাত্র বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন তিনি এই বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেন সেটা তার বিষয়। তিনি বিশেষ কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করবেন নাকি নিজের কাছে রেখে দিয়ে বাকি সমস্যার সমাধান করবেন সেই প্রসঙ্গে এখনো কোনো মন্তব্য করেননি। তবে মাসখানেক আগে হাতে আসা রিপোর্ট নিশ্চয়ই এদ্দিনে তারও পড়া হয়ে গেছে।
অভিযুক্ত সেই দুই বোর্ড পরিচালক কে? সংবাদ মাধ্যম তার খোঁজও নিচ্ছে। সেই সূত্রেই এই প্রসঙ্গে বিসিবির পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজনের কাছে পুরো বিষয়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল। ২৬ জন বোর্ড পরিচালক থাকতে মিডিয়া শুধুমাত্র খালেদ মাহমুদ সুজনের কাছেই ছুটলো কেন?
উত্তর সহজ। বিশ্বকাপের পুরোটা জুড়ে খালেদ মাহমুদ সুজন দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই দলে তার পদ ছিল টিম ডিরেক্টর। যেহেতু তিনি দলের সঙ্গেই ছিলেন তাই অভিযোগ ওঠা সম্ভাব্য দুই পরিচালকের একজন সম্ভবত তিনিই-এমন চিন্তায় মিডিয়ার তীর তার দিকে।
এসব বিষয়ে নিজের প্রতিক্রিয়ায় খালেদ মাহমুদ সুজন কী জানিয়েছেন সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসি। তার আগে জেনে নিই একটা দলে টিম ডিরেক্টরের কাজ কি?
বিসিবি বিশ্বকাপের আগে তাকে এই দায়িত্ব দিয়ে যে চিঠি দিয়েছিল সেখানে এই বিষয়টির ব্যাখ্যা এমন- ‘এই বিশ্বকাপ চলাকালে দলে আপনি বোর্ড সভাপতির পক্ষ থেকে বিসিবি এবং ক্রিকেটের স্বার্থ সংশ্লিষ্ঠ বিষয়াদি দেখভাল করবেন।’
সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিশ্বকাপে খালেদ মাহমুদ সুজন যে দলের কোচ এবং অধিনায়কের কাছে মোটেও ওয়েলকামড ছিলেন না, সেটাও আমরা জেনেছি। খোদ খালেদ মাহমুদ সুজনই জানিয়েছেন, আমাকে দলের কোনো পরিকল্পনায় রাখা হতো না। এমনটা জানলে আমি হয়তো বিশ্বকাপের দলের সঙ্গেই থাকতাম না।’
নিজের ক্ষোভ বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার আগেই জানিয়েছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন তথা ‘টিম ডিরেক্টর’। বিশ্বকাপে সুজনের সেই ক্ষোভকে বিসিবির শীর্ষস্থানীয়রা তার দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছেন। বিশ্বকাপের পর বোর্ড সভায়ও তিনি অংশ নেননি। শুধু তাই নয়, বোর্ড নতুন নির্বাচক কমিটি প্রণয়ন করেছে সেই বিষয়েও তিনি কিছুই জানতেন না-এক প্রকার সমালোচনার সুরেই এমন মন্তব্যও করেন।
এখন বিশ্বকাপের বিশেষ কমিটির রিপোর্ট প্রসঙ্গেও সুজন বলছেন, তিনি মনে করেন এই রিপোর্টে যাই থাকুন না কেন সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত। তাহলে যদি কোনো সমস্যা চিহ্নিত করা হয়ে থাকে সেটার সমাধান করা হবে। আর যদি বোর্ড মনে করে এটা প্রকাশ না করেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, তাহলে সেটাও হতে পারে। পুরো বিষয়টা নির্ভর করছে বিসিবি এবং বিসিবি সভাপতির সিদ্ধান্তের ওপর।
যে বিশ্বকাপ নিয়ে এই বিশেষ কমিটির বিশেষ রিপোর্ট, সেই বিশ্বকাপে শেষ হয়েছে ১৯ নভেম্বর। আর বাংলাদেশের বিশ্বকাপে শেষ হয়েছিল তারও আগে। বিশ্বকাপের মাঠ থেকে সবার আগে বিদায় নিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রশ্ন হলো এখন এদ্দিন বাদে এই ব্যর্থতার বিশেষ রিপোর্ট নিয়ে কি হবে? আরেকটি বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ তিন মাসের মধ্যে। পেছনের ব্যর্থতার কাহিনী শুনিয়ে সামনের দিনে তা কি কাজে লাগবে?
এসব তাহলে বলার জন্যই বলা। দেখানোর জন্যই করা!
হয়তো অনেকে বলবেন, এমন সমস্যা বা ব্যর্থতায় যাতে আর দল না পড়ে সেজন্য এই রিপোর্ট কাজে দিতে পারে। তবে এও মনে রাখতে হবে রিপোর্ট, তদন্ত, অভিযোগ, টিম ডিরেক্টর, এগুলোর একটাও কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচ জেতায় না।
বরং দল ভাঙ্গায়!