ম্যারাডোনা: ব্যথিত মানবতার অকৃত্রিম বন্ধু

  • নেয়ামত উল্লাহ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি- সংগৃহীত

ছবি- সংগৃহীত

ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট, সাদা আর কালো। ন্যায় আর অন্যায়ের দুটো ভাগ। প্রথম পথে হাঁটলে আপনি দেবতাতূল্য হবেন, আর শেষেরটায় ধরে এগোলে লোকে বলবে ধরণীর বুকে নেমে আসা সাক্ষাৎ শয়তান আপনি।

তবে একই সঙ্গে দেবতা আর শয়তান কি হওয়া সম্ভব? সম্ভব, যদি আপনি ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা হন। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটের বাইরেও একটা ভাগের অস্তিত্ব আছে, যার নাম ‘গ্রে এরিয়া’, যাকে আপনি ন্যায়সঙ্গতও বলতে পারবেন না, আবার পটভূমির কারণে ঠিক অন্যায়ও বলে দিতে পারবেন না।

বিজ্ঞাপন

সিনেমার পর্দায় আপনি গ্রে এরিয়ায় হাটা সব চরিত্র বহুবার দেখেছেন। রবিনহুড, ব্যাটম্যান, তারা ন্যায়সঙ্গত কিছু করেননি, আবার যা করেছেন তাকে অন্যায়ও বলা যায় না। তবে বাস্তব জীবনে এমন চরিত্রের দেখা মেলে কালে ভদ্রে। কালে ভদ্রে বলতে, ১০-২০ বছরে একবার নয়, শ-দুইশ বছরে এক-দু’বার। ৬৪ বছর আগের এই ৩০ অক্টোবরে জন্ম নেওয়া দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা ওই বিরলপ্রায় প্রজাতিরই একজন।

ম্যারাডোনার ফুটবল প্রতিভা সম্পর্কে কখনোই কোনো সন্দেহ ছিল না কারো। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে যখন আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তখন নিজের প্রতিভারও প্রমাণ দিচ্ছিলেন একটু একটু করে। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে দল যখন ইংল্যান্ডের মুখোমুখি, সে ম্যাচে দেখা মিলল অন্য এক ম্যারাডোনার। পিটার শিলটনের অনেক ওপরে লাফিয়ে উঠে হাত দিয়ে করা ওই গোলের বর্ণনা আপনি বহুবার শুনেছেন। ওই গোলটাকে ম্যারাডোনা নিজে বলেছেন ‘ঈশ্বরের হাত’, আর ইউরোপে তা দেখা হচ্ছিল ‘শয়তানের হাত’ হিসেবে।

এখন আপনি বলতে পারেন কাজটা তো নেহায়েত অন্যায়! অন্যায়ভাবে গোলটা আদায় করেছেন ম্যারাডোনা! ম্যাচের কনটেক্সটটা ধরতে পারলে সুরটা বদলে গেলেও যেতে পারে! ওই গোলের কারণেই তো আর্জেন্টিনায় ম্যারাডোনার দেবতাতূল্য সম্মান!

কনটেক্সটের জন্য আপনাকে ফিরে যেতে হবে ১৯৮২তে। ফকল্যান্ড যুদ্ধে ব্রিটেন হারিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে, প্রায় হাজারের কাছাকাছি সৈন্যকে মারা হয়েছিল ‘নির্বিচারে’, অন্তত ম্যারাডোনার ভাষায়। সে বিষয়টা কোয়ার্টার ফাইনালের আগে ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসছিল। সে গোলটা ছিল তারই ‘প্রতিবাদ’, ডিয়েগো অকপটে শিকার করেছিলেন পরে। এস্ট্যাবলিশমেন্টের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যখন আপনি জনমানুষের কথা বলবেন, তখন সাধারণের চোখে আপনি দেবতাতূল্য হতে বাধ্য, আর এস্ট্যাবলিশমেন্টের চোখে সাক্ষাৎ শয়তান।

ম্যারাডোনার এই প্রতিবাদী স্বত্বা মূলত গড়ে উঠেছিল যখন বুয়েনোস আইরেসের বাইলাইন ধরে তিনি যখন ফুটবলের অ-আ-ক-খ শিখছেন তখন থেকেই। ক্ষুধার জ্বালা সয়ে বড় হয়েছেন, সিস্টেমের চাকায় পিষ্ট হতে দেখেছেন কাছের মানুষকে, প্রতিবাদটা তখনই তার সহজাত হয়ে গিয়েছিল। ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারউইশ তাই তাকে নিয়ে বলেছিলেন, ম্যারাডোনার শিরা-উপশিরায় রক্ত নয়, মিসাইল দৌড়ে বেড়ায়।

ফুটবল মাঠে সর্বকালের সেরার একটা বড় তর্কের রসদ যুগিয়ে তিনি গিয়েছিলেন অবসরে। তবে এরপর তাঁর প্রতিবাদটা কমেনি একটুও। সারা জীবন তিনি কথা বলে গেছেন দলিত মানুষের পক্ষে, মানবতার পক্ষে, এস্ট্যাবলিশমেন্টের বিপক্ষে।

ফিলিস্তিনের মানুষের পক্ষ নিয়ে বহুবার তিনি প্রতিবাদে গলা উঁচিয়েছেন, তিরস্কার করেছেন বিশ্বনেতাদের। তাঁর একটা কথা, একটা ছবি খুবই বিখ্যাত, যেখানে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্যালেস্টাইনের পতাকা, বলেছিলেন, ‘আমার হৃদয় থেকে আমি একজন প্যালেস্টিনিয়ান’। এরপর আরও বহুবার কথা বলেছেন, আনঅ্যাপোলোজেটিক সুরে গেয়েছেন মানবতার গান, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তার বিরোধের গান। জর্জ বুশ বিরোধি টি-শার্ট পরে এসেছেন জনসম্মুখে। বলেছেন, ‘আমি ফিলিস্তিনি মানুষের এক নম্বর ভক্ত, আমি তাদের সম্মান করি, তাদের জন্য সমব্যথী আমি।’

শুধু প্যালেস্টাইন নয়, সিরিয়া, থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকা যেখানেই মানবতাকে ধুকতে দেখেছেন, তাঁর কণ্ঠস্বর প্রতিবাদে কেঁপে উঠেছে তখনই। করোনা মহামারিতে মানুষকে অনাহারে দেখেছেন, তাঁর মন কেদেছে উদ্বেগে। তাঁর ৬০তম জন্মদিনে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘রাস্তায় যখন অনাহারী কোনো শিশুকে দেখি, আমার মন কাঁদে। আমি জানি না খেয়ে দিনের পর দিন কাটানোর কষ্ট কী! আমি আর্জেন্টিনার মানুষকে সুখী দেখতে চাই, চাই তাদের যেন কখনো কাজের আর খাবারের অভাব না হয়।’

সব কথার শেষ কথা, তিনি সারা জীবন কথা বলেছেন সাধারণ মানুষের হয়ে। তাঁর মৃত্যুর পর তাই রামাল্লায় দশ নম্বর ছাপা আকাশী সাদা রেট্রো জার্সিতে ফিলিস্তিনি ছেলেকে কাঁদতে দেখা যায়, হাজার মাইল এদিক ওদিকে নেমে আসে শোকের ছায়া। তাকে নিয়ে এত কিছু, তিনি মানবতার অকৃত্রিম বন্ধু বলেই তো!