দুই সেঞ্চুরির এক গল্প

ক্রিকেট, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম | 2023-08-21 00:47:43

গল্পের শুরুটা তৃতীয়দিনের শেষ বিকালে। ৪ উইকেটে ১৭৪ রান তুলে বাংলাদেশ তৃতীয়দিন শেষ করলো। তখনো ইনিংস হার এড়াতে স্কোরবোর্ডে জমা চাই আরো ৩০৭ রান। উইকেটে সৌম্য সরকার ৫১ বলে ৩৯ রান নিয়ে খেলছেন। অন্যপ্রান্তে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ অপরাজিত ৪০ বলে ১৫ রান নিয়ে।

ম্যাচের চতুর্থদিন সকাল থেকেই এই দুজনেই লিখলেন হ্যামিল্টন টেস্টের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়; সেঞ্চুরির গল্প!

সকাল সকাল হাফসেঞ্চুরি পুরো করতে আরো ৯ বল লাগলো সৌম্যের। আলতো ভঙ্গিতে হাফসেঞ্চুরির আনন্দে ব্যাট তোলার সময়েই ভাবলেন-এই আনন্দ তো আরো বড় হতে পারে। এই উইকেটে তো আরো লম্বা সময় ধরে খেলা যেতে পারে। এখানে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারলে ম্যাচটা তো শেষদিনেও যেতে পারে। নিউজিল্যান্ডকে হয়তো দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামানোও যেতে পারে।

নিজের সেই রোমাঞ্চকর ইচ্ছেকে বাস্তবে রূপ দিতে সৌম্য সরকার লাঞ্চ পর্যন্ত যে কায়দায় ব্যাটিং করে গেলেন সেই সৌন্দর্য্যে হ্যামিল্টনের সবুজে সাজানো সেডান পার্কও মুগ্ধ, বিমোহিত।

নিউজিল্যান্ডের বোলাররা প্রথম ইনিংসের মতো এই দফায়ও বোলিংয়ের সেই একই কৌশল নিলো; বাউন্সারের পর বাউন্সার। ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে ফিল্ডার রেখে ব্যাক অফ লেন্থে শর্ট বল ঠোকা। আর এই কাজে সবচেয়ে বেশি পারঙ্গম তো নেইল ওয়েগনার। টিম সাউদিও একই কায়দায় শর্ট বল ঠুকে গেলেন। এমন ভঙ্গির আক্রমণ দু’ভাবে মোকাবেলা করা যায়। প্রথমত: মাথা নুইয়ে বল ছেড়ে দেয়া। বলের লাইন থেকে শরীর সরিয়ে নেয়া। দ্বিতীয়ত: বলের লাইনে গিয়ে হুক বা পুল শট খেলে রান তুলে নেয়া।

সৌম্য সরকার দ্বিতীয় পথটা বেছে নিলেন। ৬০ বলে হাফসেঞ্চুরি পুরো করার পর তিনি পাল্টা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাগ্যও সাহসীদের সঙ্গে হাটে। ৫০ থেকে ১০০ রানে যেতে সৌম্যর সময় লাগলো ৩৪ বল! আর এই রান করতে হাঁকালেন আরো ৫টি বাউন্ডারি ও ৩ ছক্কা! অর্থাৎ পরের এই ৫০ রানের মধ্যে ছক্কা-চার থেকেই তার রান এলো ৩৮!

এই পরিসংখ্যানই জানান দিচ্ছে চতুর্থদিনের সকালের সেশনে ব্যাট হাতে পুরোদুস্তর প্রভাব বিস্তার করা ব্যাটসম্যানের নাম সৌম্য সরকার। রেকর্ড ৯৪ বলে ১২ বাউন্ডারি ও ৫ ছক্কায় সেঞ্চুরি পুরো করার পর সৌম্য বদলে ফেললেন নিজের ব্যাটিং পরিকল্পনা, চিন্তা ও কৌশল।

এবার তার চিন্তা উইকেটে আরো টিকে থাকতে হবে। সময়টা দীর্ঘ করতে চাই। এতক্ষণ ছিলো আক্রমণের মেজাজে রক্ষণ। এবার সেটা রূপ নিলো রক্ষনের কৌশলে আক্রমণ। ১৭১ বলে ১৪৯ রান করে নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির আনন্দ নিয়ে সৌম্য যখন ফিরছেন তখনো আক্ষেপের ছাপ তার চোখে স্পষ্ঠ-আহা ইনিংসটা আরো বড় করা যেত! সেঞ্চুরির পর শেষের ৪৯ রান এলো ৭৭ বলে। যেখানে বাউন্ডারি মাত্র ৯টি।

৫০ থেকে ১০০। ১০০ থেকে ১৪৯ রান। সৌম্য সরকারের এই রান তোলার ধাপ গুলো জানান দিচ্ছে পর্যায়ক্রমে ম্যাচ পরিস্থিতির সঙ্গে কিভাবে তিনি নিজের ব্যাটিং কৌশলকে বদলে ফেলেছিলেন। হ্যামিল্টন টেস্টে নিজের রেকর্ড সেঞ্চুরির রোমাঞ্চকর গল্পটা কোন অনুলিখন নয়, পুরোটাই নিজেই লিখেছেন সৌম্য সরকার!

সবুজে মোড়া সেডন পার্কের সঙ্গে ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকারের বন্ধুত্বও বেশ পুরানো। এই মাঠেই ওয়ানডেতে নিজের প্রথম হাফসেঞ্চুরি পেয়েছিলেন এই বাঁহাতি, ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের আসরে। এবার সেই ভেন্যুতেই দেখা মিললো প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরিরও। তাও আবার রেকর্ড ৯৪ বলে। বলের হিসেবে দ্রæততম টেস্ট সেঞ্চুরির এই রোমাঞ্চকর রেকর্ডটা এতদিন শুধু তামিম ইকবালের ছিলো। সৌম্য সেই রেকর্ডে ভাগ বসালেন।

হ্যামিল্টনে সৌম্যের সেঞ্চুরিকে যদি বলি রোমাঞ্চকর তবে মাহমুদউল্লা রিয়াদের ১৪৬ রানের গল্পটা শুধুই ক্রিকেটীয় রোমান্সের! এই মাঠের পিচ কিউরেটরের উচিত মাঠের এক টুকরো কেটে সেটাকে ছবির ফ্রেম বানিয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে উপহার দেয়া। হ্যামিল্টনের সেডন পার্কের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাটিং সখ্য এখন অমনিই রোমান্সের!

এই মাঠে দুটি টেস্ট খেলেছেন, দুটিতেই সেঞ্চুরি। জীবনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি এই মাঠে। আপাতত শেষ টেস্ট সেঞ্চুরি এবং টেস্টে সর্বোচ্চ রানও তার এখানেই! এই মাঠের চার টেস্ট ইনিংসে তার রান ৩২৫। এখানে ইনিংস প্রতি রান গড় ৮১.২৫। টেস্ট ক্যারিয়ারের বাকি সব ম্যাচ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এই মাঠে খেলার দাবি এখন জানাতেই পারেন!

শুধু কি টেস্ট? এই মাঠে এখন পর্যন্ত নিজের খেলা একমাত্র ওয়ানডে ম্যাচেও সেঞ্চুরি আছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। তাও আবার বিশ্বকাপের ম্যাচে!

ক্যারিয়ারের বাকি সময়ে আরো অনেক সেঞ্চুরি অপেক্ষা করছে সৌম্য সরকার ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের জন্য। তবে হ্যামিল্টনের সেডন পার্ক সত্যিকার অর্থেই দুজনের ক্রিকেট আত্মজীবনীতে আলাদা অধ্যায় পাচ্ছে!

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে সেডন পার্কে এই সেঞ্চুরি, সখ্য, রোমাঞ্চ এবং রোমান্স-সব দৃশ্যে এসে শেষ হচ্ছে একই ক্লাইমেক্সে; ম্যাচে হার!

এ সম্পর্কিত আরও খবর