উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ শুরুর অন্যতম পীঠস্থান উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। নবজাগৃত বাংলায় সুরুচি, নন্দনতত্ত্ব ও সৌন্দর্য্যবোধের অনেকটাই ঠাকুরবাড়ির অবদান।
দ্বারকানাথের আমল থেকেই এ বাড়িতে নিজস্ব একটি সংস্কার গড়ে ওঠে। এই নব উত্তরণের পর্বে ঠাকুরবাড়ির মেযেরাও অন্দরমহলের আবছা পর্দার আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন নি। নবযুগের ভিত গড়ার কাজে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হাত লাগিয়েছেন।
প্রথমদিকে অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তবে এদের অনেকেই শিল্প ও সাহিত্যে বিশেষ ভূমিকা রেখে গেছেন। নিজের চলার মসৃণ পথ তারা পাননি, পথ তৈরি করে নিতে হয়েছিল তাদের। তারা তৎকালীন নারীদের জন্য উন্মুক্ত করেছেন সম্ভাবনার পথ। মূলত ঔপনিবেশিক শাসনে বাঙালি নারীর এগিয়ে যাওয়ার আদি প্রেরণা ও শক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের কাছ থেকেই। চলুন জেনে আসি ঠাকুরবাড়ির তেজস্বিনীদের সম্পর্কে-
সারদা দেবী
সারদা দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মা। মাত্র ছয় বছরের সারদাকে যশোর থেকে বিয়ে করে এনেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার আসল নাম শাকম্বরী। ঠাকুরবাড়িতে বৌ হয়ে আসার পর নাম বদলে রাখা হয় সারদা।
সেকালে সমাজের একটা বড় অংশে নারীরা লেখাপড়ার নাম মুখে তুলতো না। বই পড়ে বিধবা হওয়ার ভয়ে যখন পাড়ার ছেলে বৌরা কাতর ছিল, সেখানে সারদা দেবী ছিলেন পড়ালেখা জানা মেয়ে। মাইনে দেয়া বৈষ্ণবীর কাছে পড়তেন চাণক্যশ্লোক, মহাভারত ও রামায়ণ। পারতেন চিঠি লিখতেও। অবসর সময় কাটতো তার বইয়ের সঙ্গে। হাতের কাছে কোনো বই যদি নাও থাকতো তবে অভিধানই খুলে পড়তে লেগে যেতেন।
আরও পড়ুন: ঠাকুরবাড়ির তেজস্বিনী
ব্রাহ্মধর্মের প্রতি কোনো প্রকার আকর্ষণ না থাকলেও উপেক্ষা করার উপায় নেই যে, সারদা ছিলেন নিতান্তই পতিভক্ত নারী। স্বামীর মঙ্গলের জন্য ব্রাহ্মোপাসনা ও হিন্দুমতে পূর্জা-আর্চার কোনোটিরই কমতি রাখেননি তিনি।
প্রৌঢ়া বয়সে সারদা খুব একটা নড়াচড়া করতে পারতেন না বলে ঘরের কাজকর্মে হাত লাগানো দায় ছিল। তবে ঠায় বসেও থাকেননি তিনি। সারদার সামনে বসেই দাসীরা ছেলের বৌদের রূপটান লাগাতো। আর সেখানেই অন্তঃপুরের নানান নালিশ ও মনোমালিন্যের বিচার সমাধান করতেন তিনি।
ঠাকুরবাড়িতে সারদা দেবীর যে চিত্রটি আমরা পাই তা খুব বেশি স্পষ্ট না তবে তার স্বিগ্ধতা এড়িয়ে যাওয়ার মতো বিষয় ছিল না। ঠাকুরবাড়ির অনন্যা রমণী তালিকায় তিনিও উজ্জ্বল।
যোগমায়া
যোগমায়া ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথের পুত্র গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী। শ্বাশুড়ি দিগম্বরীর মতো সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তারও আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। যোগমায়ার ছিল পড়াশোনার প্রতি বিশেষ আগ্রহ। বেশ ভালো বাংলা জানতেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের মেজোদাদা সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘তিনি ছিলেন আমাদের এক প্রকার শিক্ষয়িত্রী।’ তিনি আরও বলেছেন, 'আমাদের আসল আড্ডা ছিল মেজকাকীমার ঘর। সেই আমাদের শিক্ষায়, বিশ্রামস্থান।’
দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার পর বাড়িতে লক্ষীজনার্দনের নিত্য পূজা বন্ধ করার উপায় হলে যোগমায়া তার সন্তানদের নিয়ে দ্বারকানাথের বৈঠকবাড়িতে থাকা শুরু করেন। কারণ, তিনি লক্ষীজনার্দনের পক্ষে। অন্যদিকে দেবেন্দ্রনাথরা রয়ে গেলেন ৬ নম্বর বাড়িতে। সেই থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দুটি বাড়ির হিস্যায় পরিণত হয়। এটি হয়েছিল যোগমায়ার স্বঅভ্যাস ও নিজস্বতা বজায় রাখার দৃঢ়তার কারণে। ঘরের ছেলেপুলেদের শিক্ষাদানকারী এই মেজোকাকীমার আলাদা হয়ে যাওয়ায় বড় দুঃখ পেয়েছিলেন মহর্ষিপুত্ররা।