শিল্পকারখানা গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে তুঘলকি সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন অনেকে। এতে করে শিল্পের বিকাশ চরমভাবে ব্যাহত হতে পারে, পাশাপাশি যারা শিগগিরই উৎপাদনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তারাও ঝরে পড়তে পারেন।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বিদ্যমান শিল্পের জন্য বর্তমান দর, আর শিগগিরই উৎপাদনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া শিল্প (প্রতিশ্রুত গ্রাহক- যাদের গ্যাসের সংযোগ অনুমোদিত আছে) এবং নতুন করে যারা সংযোগের আবেদন করবেন তাদের জন্য পুরোপুরি ভিন্ন ৩টি ক্যাটাগরির কথা বলা হয়েছে।
বিদ্যমান শিল্পের জন্য বর্তমান দর ৩০ টাকা অপরিবর্তিত রাখার কথা বলা হয়েছে। আর প্রতিশ্রুত গ্রাহকের অর্ধেকের দাম বিদ্যমান দরে, অর্ধেকের দাম চড়াদরে আনা এলএনজি দরে, আর নতুন শিল্পের জন্য এলএনজি প্রাইস (প্রায় ৬০ টাকা) নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু কেনো গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। সে বিষয়ে পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড থেকে প্রতি ঘনফুট গ্যাস ১ টাকা দরে, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি থেকে ১.২৫ টাকা দরে, বাপেক্স থেকে ৪ টাকা দরে কেনা হয়। এরপর বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ ও টাল্লোর কাছ থেকে কেনা গ্যাসের সংমিশ্রণে গড় দর দাঁড়ায় ৬.০৭ টাকা ঘনমিটার। দেশীয় এসব উৎস থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে দৈনিক কমবেশি ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এলএনজি আমদানি থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্য দাড়িয়েছে ২৪.৩৮ টাকা। আর গ্যাসের গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ২২.৮৭ টাকা। এতে করে প্রতি ঘনমিটারে ১.৫৬ টাকা লোকসান হয়েছে পেট্রোবাংলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছিল ৬৫ টাকা, যা আগস্টে (২০২৪) ৭১ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। পেট্রোবাংলার ঘাটতি পূরণ করতে ওই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা গত ২৭ ডিসেম্বর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। অন্যদিকে আইএমএফ এর পক্ষ থেকেই ভর্তুকি কমিয়ে আনার চাপ রয়েছে। ইতোমধ্যেই তাদের ফর্মুলা অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন ব্যবসায়ী, আমলা এবং অন্যান্য শ্রেণি প্রেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বললে কেউই একে সমর্থন করেননি। প্রায় সকলেই তীর্যক মন্তব্য করেছেন, বলেছেন পুরোপুরি পাগলামি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এতে করে চরম অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। সারা বিশ্বে নতুন উদ্যোক্তাদের নানা রকম সুবিধা দিয়ে বাজারে যায়গা করে দেওয়া হয়, আর আমাদের দেশে প্রথমেই তাকে গলা চেপে ধরার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্প যখন ৩০ টাকা দরের গ্যাস দিয়ে পণ্য উৎপাদন করবে, একই সময়ে নতুন বাজারে আসা শিল্পকে ৬০ টাকা দিয়ে গ্যাস কিনতে হবে। সে কি করে প্রতিযোগিতায় টিকবে। অবশ্যই টিকতে পারবে না। বাধ্য হয়ে শিল্প বন্ধ করে দিবে অথবা চালুই করবে না। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। আর নতুন বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না, এতে বেড়ে যাবে বেকারত্বের হার। যার নেতিবাচক প্রভাব হবে অনেক সুদূর প্রসারী। আমাদের দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রেসিডেন্ট হাতেম আলী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, এই প্রস্তাব পাস হলে শিল্পায়ন থমকে যাবে। নতুন করে বিনিয়োগ আসবে না। একটি অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। কেউ ৩০ টাকা দিয়ে গ্যাস কিনবে আবার কেউ ৬০ টাকার বেশি দিবে, যারা বেশিদামে কিনবে তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। কারণ বাজারতো একটাই।
হাতেম আলী বলেন, দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানো উচিৎ। এতে করে যে ঘাটতি রয়েছে সেটা পূরণ করা সম্ভব। গত ১৫ বছর আমরা দেশীয় গ্যাস আহরণ না করে আমদানির দিকে ঝুঁকেছি যার ফলাফল আজকের এই পরিস্থিতি। আমরা কেনো আমদানির দিকে গেলাম, কারণ হচ্ছে আমদানি করলে কমিশন বাণিজ্য করার সুযোগ থাকে। তাই তারা সেদিকে ঝুঁকে ছিল।
তিনি বলেন, বর্তমানের দরটাই অনেক বেশি, এতেই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও আমরা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবো যদি পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। চাহিদার তুলনায় অনেক কম গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে, এতে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী নেতা বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমলারা কৌশলে সরকারকে অজনপ্রিয় করার কাজটি করে যাচ্ছে। না হলে এমন পাগলামী প্রস্তাব কি করে আসে। বিগত ১৫ বছর যেসব ব্যবসায়ী মার্কেটে জায়গা করে নিয়েছে তারাই লুটেপুটে খেতে চায়, আর নতুনদের আসতে দিবে না, এ প্রস্তাব থেকে তাই প্রমাণ করে।