মৃত্যুর সময় হলে কাউকে অবকাশ দেওয়া হবে না
সূরা মুনাফিকুনের ৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা মানুষকে এটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, ‘ভূ ও নভোমণ্ডলের ধন-ভাণ্ডার আল্লাহরই। মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহযোগীদের জন্য খরচ করতে বা দান করতে মুসলমানদের নিষেধ করতো। তাদের ওই আচরণের কথা তুলে ধরে এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘তারাই তথা মুনাফিকরা বলে- আল্লাহর রাসূলের সাহচর্যে যারা আছে তাদের জন্যে ব্যয় করো না। পরিণামে তারা আপনা-আপনি সরে যাবে রাসূলের পাশ থেকে। ভূ ও নভোমণ্ডলের ধন-ভাণ্ডার আল্লাহরই কিন্তু মুনাফিকরা তা বোঝে না।’
ইতিহাসে আছে, বনু মুস্তালিরে যুদ্ধের পর এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দু’জন মুহাজির ও আনসারের মধ্য পানি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। এ সময় তারা নিজ নিজ গোত্রকে সাহায্যের আহবান জানায়। গোত্রভিত্তিক এভাবে সাহায্য চাওয়ার প্রেক্ষিতে রক্তপাতের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
নবী করিম (সা.) ঘটনা জানতে পেরে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘এই দু’ব্যক্তিকে তাদের অবস্থার ওপর তথা মন্দ পরিণতির ছেড়ে দাও। এরূপ সাহায্য কামনা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও দুর্গন্ধযুক্ত। এটি জাহিলি যুগের আহবান। তাদের অন্তর থেকে জাহিলি যুগের মন্দ প্রভাব এখনও দূর হয়নি। এ দুই ব্যক্তি ইসলামের শিক্ষা ও কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত নয়। ইসলাম সব মুসলমানকে পরস্পরের ভাই বলেছে এবং যে আহ্ববান পরস্পরকে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করে- তা মূল্যহীন।’
এভাবে মদিনায় হিজরতের পর প্রথমবারের মতো মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলেও নবী করিম (সা.)-এর প্রজ্ঞায় উভয় দল শান্ত হয়।
কিন্তু মদিনার মুনাফিকদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এ বিরোধের সুযোগে নিজের বিদ্বেষ প্রকাশ করে নিজের কিছু সঙ্গী ও সমর্থকদের বলে, ‘আমাদের কারণেই তারা আমাদের ওপর চেপে বসেছে। আমরা মদিনার অধিবাসীরা মক্কার মুহাজিরদের নিজ ভূমিতে আশ্রয় দিয়ে তাদেরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছি। আল্লাহর শপথ করে বলছি, মদিনায় ফিরে গিয়ে আমরা সম্মানিত ও শক্তিশালীরা তথা মদিনার অধিবাসীরা মুহাজিরদের বের করে দেব।’
অর্থাৎ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সব মুহাজির মুসলমানদের মদিনা থেকে বের করে দেওয়ার শপথ করে। তার এ বক্তব্য নবী করিম (সা.)-এর কানে গেছে বুঝতে পারার পর, সে এমন কথা বলেনি বলে রাসূলের কাছে জানায়।
কিন্তু সূরা মুনাফিকুনের ৮ নম্বর আয়াতে উবাইয়ের এমন কপট আচরণের তীব্র নিন্দা জানান স্বয়ং আল্লাহ। ওই আয়াতে আল্লাহতায়ালা মুনাফিক নেতা উবাই ও তার দলবলকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তারাই বলে- আমরা যদি মদিনায় ফিরে আসি তবে সেখান থেকে সবল অবশ্যই দুর্বলকে বহিস্কৃত করবে। শক্তি তথা সম্মান তো আল্লাহ, তার রাসূল ও মুমিনদের কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।’
বস্তুত সব ক্ষমতা ও শক্তির মালিক আল্লাহ। মুনাফিকরা এটা যদি বুঝত, তাহলে তারা মুসলমানদের সম্মানের বিষয়ে অবজ্ঞা করে কথা বলত না।
আসলে নিফাক বা কপটতার একটি বড় কারণ হলো- দুনিয়া এবং সম্পদ আর সন্তান-সন্ততির প্রতি অতিরিক্ত মোহ ও আকর্ষণ। তাই সূরা মুনাফিকুনের নয় নম্বর আয়াতে মুমিনদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।’
এটা ঠিক যে সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদ আল্লাহর নেয়ামত। কিন্তু এসব সম্পদকে কেবল আল্লাহকে পাওয়ার পথে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে এসব সম্পদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক আল্লাহর দাসত্বের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ মহাবিপদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
বিষয়টি সূরা মুনাফিকুনের দশ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ওই আয়াতে দান-খয়রাতের গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় করো। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে আরও কিছুকাল বেঁচে থাকার অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’
দুনিয়ার জীবনে আমরা প্রায়ই দেখি, অনেক মানুষ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে উদাসীনতার ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। এ সময় দান-খয়রাতের গুরুত্ব অনুভব করেন। অতীত কাজকর্মের জন্য অনুশোচনা করেন এবং আরও কিছুকাল বাঁচার আশা পোষণ করেন। কিন্তু তাদের সে আবেদন বৃথা। এটা সূরা মুনাফিকুনের শেষ আয়াতে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও জোরালো ভাষায় বলা হয়েছে।
ওই আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যুর নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা করো, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন।’